বিচারক সংকটে আটকা হত্যা মামলার আপিল শুনানি, আরেকটি সাক্ষ্যগ্রহণে
২৫ ফেব্রু ২০২৪, ১১:২৪ পূর্বাহ্ণ
স্টাফ রিপোর্টার:
ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বড় মামলা পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলা। ১৫ বছর অতিবাহিত হলেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি কোনো মামলার। দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলার বিচার আপিল বিভাগে শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের অপর মামলাটি এখনো বিচারিক (নিম্ন) আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণের গণ্ডি পার হয়নি। হত্যা মামলার আপিল শুনানি কবে শুরু হবে, তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।
জানা গেছে, আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ হলে পিলখানা মামলার আপিল শুনানির জন্য নতুন একটি বেঞ্চ গঠন করতে পারেন। শিগগিরই আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ হবে।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছেন, আপিল বিভাগে বিচারক সংকটের কারণে সর্বোচ্চ আদালতে মামলাটির শুনানি শুরু করা যাচ্ছে না। তবে দণ্ডিতদের সাজা দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে বহাল থাকবে বলে আশা করেন তিনি।
এই দিনে যা ঘটেছিল
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির এই দিনে সকাল ৯টা ২৭ মিনিটের দিকে বিডিআরের বার্ষিক দরবার চলাকালে হলে ঢুকে পড়েন একদল বিদ্রোহী সৈনিক। তাদের একজন তৎকালীন মহাপরিচালকের (শাকিল আহমেদ) বুকে বন্দুক তাক করেন। সূচনা হয় ইতিহাসের সেই নৃশংসতম ঘটনার। বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে পরিবারকে জিম্মি করে ফেলেন জওয়ানরা। পুরো পিলখানায় সৃষ্টি হয় ভীতিকর পরিস্থিতি। চারটি প্রবেশ গেট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশপাশের এলাকায় গুলি ছুঁড়তে থাকেন বিদ্রোহীরা।
তারা দরবার হল ও এর আশপাশের এলাকায় সেনা কর্মকর্তাদের ওপর গুলি করতে থাকেন। তাদের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়তে থাকেন সেনা কর্মকর্তারা। ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান হয়। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। পরে পিলখানার ভেতরে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। ৩৬ ঘণ্টার এ হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা, এক সৈনিক, দুই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ বিজিবি সদস্য ও পাঁচ বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন।
বহুল আলোচিত এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় (পিলখানা হত্যা মামলা) ১৩৯ জনের ফাঁসি, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট।
মামলার বিচারকার্য
আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়।
হত্যা মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় আসামির সংখ্যা বেড়ে হয় ৮৫০ জন। এছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
রাজধানীর পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ইতিহাসের কলঙ্কজনক এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে (তিন বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত) কারাদণ্ড, ২৭৮ জনকে খালাস এবং চার আসামি বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় তারা অব্যাহতি পান।
আদালতের রায় ঘোষণার পর ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে যায়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আসামিরা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল ও জেল আপিল করেন। এর মধ্যে ৬৯ জনকে খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ উদ্যোগ নেন।
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দেন। দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শুনানি শুরু হয়।
মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতরা সবাই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (তৎকালীন বিডিআর) সদস্য ছিলেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীও রয়েছেন। এর মধ্যে নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ২০১৫ সালের ৩ মে রাজশাহী কারাগারে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
পিলখানার দুঃসহ স্মৃতির ১৫ বছর
হাইকোর্ট রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জন আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন। একই সঙ্গে আটজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেওয়া হয়। এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জন আসামির মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এদের মধ্যে দুজন আসামির মৃত্যু হয়েছে এবং ১২ জন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।
পিলখানা ট্র্যাজেডির ভয়াবহ নৃশংসতার পর একসঙ্গে হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে আলাদা দুটি মামলার বিচার শুরু হয়েছিল। বিচারিক আদালত ও হাইকোর্ট দুই জায়গায় হত্যা মামলার বিচার শেষ হয়েছে। এখন অপেক্ষা, আপিল বিভাগে চূড়ান্ত আইনি লড়াইয়ের।
তবে ১৫ বছরেও নিম্ন আদালতে সুরাহা হয়নি বিস্ফোরক আইনে করা মামলাটি। তাই হত্যা ও বিদ্রোহ মামলায় খালাস মিললেও কারাগার থেকে বের হতে পারছেন না দেড় শতাধিক আসামি। এ মামলায় আপিল দ্রুত শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির দাবি জানিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম মৃত্যুদণ্ডের আসামির পক্ষে ও যাবজ্জীবন পাওয়াদের পক্ষে ৩৯টি আপিল করেছেন। বাকি দণ্ডিতদের ২৯টি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন বলেও জানান। অথচ এ হত্যাকাণ্ডের মামলায় উচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন পাঁচ বছর আগে। সেই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিল, লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করা শেষ হয়েছে প্রায় তিন বছর। এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্র ও আসামি উভয়পক্ষ আপিলের সারসংক্ষেপ (কনসাইজ স্টেটমেন্ট) জমা দিয়েছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম জানান, আপিল আবেদন চূড়ান্ত শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টের কার্যতালিকায়(কজলিস্টে) উঠেছিল। তালিকায় রয়েছে, তবে শুনানি হবে কি না জানি না। আর বিচারক সংকট তো রয়েছে।
বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ
পিলখানা বিদ্রোহের ঘটনা যেমন পুরো বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল, তেমনি এক মামলায় এত আসামির সর্বোচ্চ সাজার আদেশও ছিল নজিরবিহীন। ওই ঘটনায় দুটি মামলার মধ্যে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে হত্যা মামলার রায় হলেও ১৪ বছরেও শেষ হয়নি বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের বিচারকাজ।
আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় এক হাজার ২৬৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এই ১৫ বছরে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে মাত্র ২৭২ জনের। এখনো সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। দুই মামলার আসামি হওয়ায় হত্যা মামলায় খালাস পাওয়া এবং যাদের ১০ বছরের কম সাজা হয়েছে এমন ২৭৮ জন মুক্তি পাননি। ১৫ বছর ধরে তারা জেলে। বিভিন্ন সময় আবেদন করা হলেও জামিন হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, প্রায় ১৩ শ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ২৭২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। কবে শেষ হবে বলা যাচ্ছে না।
আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রধান বিচারপতির কাছে আমাদের আকুল আবেদন— এ নিরীহ আসামিদের বিষয়সহ সবদিক বিবেচনা করে এই মামলার শুনানি কার্যক্রম যেন দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়। তবেই ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ১৩৯ জনের ফাঁসি বহালের পাশাপাশি যাদের সাজা কমানো হয়েছে সে বিষয়েও শক্ত অবস্থান নেবে রাষ্ট্রপক্ষ। আশা করছি যে ট্রায়াল কোর্ট যাদেরকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন এবং যাদেরকে হাইকোর্ট কনফার্ম করেছেন বা মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন সেটা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও বহাল থাকবে। এছাড়া আপিল বিভাগে বিচারক সংকটের কারণে মামলা শুরু করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। আশা করা যাচ্ছে— বিচারক এলে আলাদা বেঞ্চ করা সম্ভব হবে।