শেষ বাজেটে মেয়র আরিফের কণ্ঠে ক্ষোভ-হতাশা

Daily Ajker Sylhet

admin

২৬ অক্টো ২০২৩, ০৬:০৮ অপরাহ্ণ


শেষ বাজেটে মেয়র আরিফের কণ্ঠে ক্ষোভ-হতাশা

স্টাফ রিপোর্টার:
সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেছেন- মহানগরের শাহজালাল মাজার সড়ক ও আম্বরখানা থেকে জিন্দাবাজার-বন্দর হয়ে সার্কিট হাউস পর্যন্ত মাটির নিচ দিয়ে বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপনের পর আরও ১১টি সড়কে ভূগর্ভস্থ বিদ্যুতায়নের প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলো সিসিক। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়- শেষ পর্যন্ত সিলেটের সাথে চরম বৈষম্যমূলক নীতি দেখানো হয়েছে। অন্যান্যা অঞ্চলের জন্য এই প্রজেক্ট অনুমোদন দিলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সিলেটের প্রজেক্ট বাদ দিয়েছেন। এতে সিলেটবাসী বঞ্চিত হয়েছেন।

ব‍ৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে সিসিকের ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে মেয়র আরিফ এসব কথা বলেন।

ব‍ৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টায় দক্ষিণ সুরমার চন্ডিপুল এলাকার একটি অভিজাত কনভেনশন হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সিসিক মেয়র ৯২৫ কোটি ৪ লক্ষ ৪৯ হাজার টাকার এ বাজেট ঘোষণা করেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।

প্রণয়নকৃত বাজেটে আয় ও ব্যয় সমপরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে।

মেয়র হতাশা ব্যক্ত করে আরও বলেন- সিলেট সিটি করপোরেশনের বর্ধিত ওয়ার্ডগুলোর উন্নয়নে ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ৪ হাজার ১ শ ৮৯ কোটি টাকার একটি বড় প্রকল্প ডিপিপি প্রণয়ন করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হলেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই। বর্ধিত এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য সকল নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জরুরি প্রয়োজন থাকলেও এ বিষয়ে সরকারের নির্লিপ্ততা নতুন ওয়ার্ডগুলোর বাসিন্দাকে চরমভাবে হতাশ করবে।

বক্তব্যের শুরুতে মেয়র আরিফ বলেন- অন‍্যান‍্যবারের মতো এবারের আমার বাজেট ঘোষণা নয়, এটি আমার শেষ বাজেট।

মেয়র আরিফ বলেন- ‘অপ্রিয় হলেও সত্য- কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি চরম হতাশ হয়েছি। উদাহরণস্বরূপ বলতে হয়, এই নগরীর জন্য আমি ২০১৪ সাল থেকে একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট প্রকল্পের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। সারি নদীতে ৫ কোটি লিটার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য বড়শালায় ১৩ একর জায়গা অধিগ্রহণসহ প্লান্ট নির্মাণের ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রক্রিয়া গ্রহণের প্রায় ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও এই প্রকল্পের কোনো অগ্রগতি হয়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রীর কাছে বারবার ধর্ণা দিয়েও আজ পর্যন্ত এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি।

একইভাবে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের স্বতন্ত্র সুয়ারেজ সিস্টেম চালু, যানজট নিরসনের লক্ষ্যে চারটি পার্কিং ব্যবস্থা, ৪টি পৃথক পৃথক খেলার মাঠ ও ৪টি পৃথক পৃথক গরুর হাটের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব প্রেরণ করা হলেও এক্ষেত্রে এখনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। আজ শহর রক্ষা বাঁধ, সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকার জন্য স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ প্ল্যান্টসহ নানাবিধ জনস্বার্থমূলক প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে, কিন্তু অনেক আগে থেকেই এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়ার জন্য আমি বারবার সরকারের বিভিন্ন প্লাটফর্মে তাগাদা দেওয়া স্বত্বেও কোন অগ্রগতি নেই। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, গুরুত্ব বিবেচনায় সিলেটের চেয়ে আরো অনেক পিছিয়ে থাকা সিটি কর্পোরেশনকে বড় বড় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অন্য সিটি কর্পোরেশন কত টাকা বরাদ্দ পেয়েছে এবং সিলেট সিটি কর্পোরেশন কত টাকা বরাদ্দ পেয়েছে গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আপনারা এই বিষয়ে একটু খোঁজ নিলেই সবকিছু আপনাদের কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে।

সবচেয়ে হতাশার বিষয় হচ্ছে, আপনারা জানেন বিগত বছর ভয়াবহ বন্যার কারণে সিলেটের লাখ লাখ মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও কষ্ট সহ্য করেছেন। এই বন্যার পর আমরা সরকারের তরফ থেকে শহর রক্ষা বাঁধ তৈরি, নদী খননসহ নানামুখী আশার বাণী শুনেছিলাম। কিন্তু আপনারাই বলুন এখন পর্যন্ত এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে কী না?

অপ্রিয় হলেও সত্য, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৈষম্য ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে আমার উপর অনেক অবিচার করা হয়েছে। একদিকে সিলেটবাসীর পাহাড়সম প্রত্যাশা অন্যদিকে বিগত দুটি মেয়াদে বিরুদ্ধ স্রোতের বিরুদ্ধে আমাকে একাই লড়াই করতে হয়েছে। মাঝে মাঝে হতাশা আমাকে ঘিরে ধরেছে, কিন্তু আমি হতোদ্যম হইনি-থেমে যাইনি। সিলেটের উন্নয়নের স্বার্থে আমি সকল অবিচার-ষড়যন্ত্রকে ভুলে গিয়ে বারবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছি।’

ঘোষিত বাজেটে উল্লেখযোগ্য আয়ের খাতগুলো হচ্ছে- হোল্ডিং ট্যাক্স ৪৮ কোটি ৩৫ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা, স্থাবর সম্পত্তি হস্থান্তরের উপর কর ২৫ কোটি টাকা, ইমারত নির্মাণ ও পুনঃ নির্মাণের উপর কর ২ দুই কোটি ৫০ লক্ষ টাকা, ট্রেড লাইসেন্স ১০ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা, বিজ্ঞাপনের উপর কর ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা, বিভিন্ন মার্কেটের দোকান গ্রহীতার নাম পরিবর্তনের ফি ও নবায়ন ফিস বাবদ ৮০ লক্ষ টাকা, ঠিকাদারী তালিকাভুক্তি ও নবায়ন ফিস বাবদ ৩০ লক্ষ টাকা, ল্যাব টেষ্ট ফিস বাবদ ৬০ লক্ষ টাকা, বাস টার্মিনাল ইজারা বাবদ আয় ২ কোটি টাকা, ট্রাক টার্মিনাল ইজারা বাবদ আয় ৫০ লক্ষ টাকা, খেয়াঘাট ইজারা বাবদ ২০ লক্ষ টাকা, সিটি কর্পোরেশনের সম্পত্তি ও দোকান ভাড়া বাবদ ৫ কোটি টাকা, রোড রোলার ভাড়া বাবদ আয় ৫০ লক্ষ টাকা, রাস্তা কাটার ক্ষতিপূরণ বাবদ আয় ৩০ লক্ষ টাকা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খাতে আয় ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা, দক্ষিণ সুরমায় জননেত্রী শেখ হাসিনা শিশু পার্কের টিকিট বিক্রয় থেকে আয় ১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকাসহ রাজস্ব হিসাব উপাংশ ১ এ মোট ১০৫ কোটি ১২ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা এবং পানির সংযোগ লাইনের মাসিক চার্জ বাবদ ৭ কোটি টাকা, পানির লাইনের সংযোগ ও পুনঃসংযোগ ফিস বাবদ ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা, নলকুপ স্থাপনের অনুমোদন ও নবায়ন ফি বাবদ ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকাসহ রাজস্ব হিসাব উপাংশ ২ এ মোট ১৮ কোটি ২৭ লক্ষ ১৬ হাজার টাকা। সম্মানীত নগরবাসী নিয়মিত হোল্ডিং ট্যাক্সসহ অন্যান্য বকেয়া পাওনা পরিশোধ করলে বাজেট বছরে সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব খাতে সর্বমোট ১২৩ কোটি ৪০ লক্ষ ১১ হাজার টাকা আয় হবে বলে আশা করছি। বাজেটে সিলেট সিটি কর্পোরেশন, নন-ডিপিপি এবং ডিপিপি সরকারি অর্থায়নে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন খাতে প্রাপ্তি ৫২৬ কোটি ৫১ লক্ষ টাকা এবং নিজস্ব মার্কেট নির্মাণ খাতে ৩৭ কোটি টাকা আয় ধরা হয়েছে।

এবারের বাজেটে রাজস্ব খাতে সর্বমোট ১১২ কোটি ৩৫ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে। তন্মধ্যে সাধারণ সংস্থাপন খাতে ৫২ কোটি ৭৭ লক্ষ টাকা, শিক্ষা খাতে ব্যয় ৪ কোটি ১০ লক্ষ টাকা, স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ১ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা, পরিচ্ছন্নতা খাতে ব্যয় ১৯ কোটি ৬০ টাকা, বিদ্যুত প্রকৌশল/সড়ক বাতি খাতে ব্যয় ৩ কোটি ১০ লক্ষ টাকা, সমাজকল্যান ও বস্তি উন্নয়ন খাতে ব্যয় ৫ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা, বিবিধ ৭ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা, এর মধ্যে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ খাতে ৫০ লক্ষ টাকা, বৃক্ষ রোপণ ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ৪৫ লক্ষ টাকা, মোকদ্দমা ফি ও পরিচালনা ব্যয় বাবদ ৫০ লক্ষ টাকা, জাতীয় দিবস উদযাপন খাতে ৯০ লক্ষ টাকা, নাগরিক সম্বর্ধনা ও আপ্যায়ন ব্যয় বাবদ ৮০ লক্ষ টাকা, খেলাধুলা ও সংস্কৃতি ব্যয় খাতে ১৫ লক্ষ টাকা, মেয়র কাপ ক্রিকেট, ফুটবল ও ব্যাডমিন্টন টুর্ণামেন্ট ব্যয় বরাদ্দ ১ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা, রিলিফ/জরুরী ত্রাণ ব্যয় বরাদ্দ ২ কোটি টাকা, আকষ্মিক দূর্যোগ/বিপর্যয়/করোনা ব্যয় বরাদ্দ ২ কোটি টাকা, কার্যালয়/ভবন ভাড়া বাবদ বরাদ্দ ১ কোটি টাকা, নিরাপত্তা/সিকিউরিটি পুলিশিং ব্যয় খাতে ৯০ লক্ষ টাকা, ডিজিটাল মেলা আয়োজনে ব্যয় বরাদ্দ ২০ লক্ষ টাকা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া পানি সরবরাহ শাখার সংস্থাপন ব্যয় সহ পানির লাইনের সংযোগ ব্যয়, পাম্প হাউজ, মেশিন, পাইপ লাইন মেরামত সংস্কার ও বিদ্যুত বিল পরিশোধসহ মোট ১৮ কোটি ০১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে ।

বাজেটে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে রাজস্ব খাতে ব্যয় বাবদ মোট ৩৩ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে । তন্মধ্যে রাস্তা নির্মাণ, রাস্তা মেরামত/সংস্কার, ব্রীজ/কালভার্ড নির্মাণ, ব্রীজ/কালভার্ড মেরামত/ সংস্কার, ড্রেইন নির্মাণ/মেরামত, সরঞ্জাম যন্ত্রপাতি ও সম্পদ ক্রয়, সিটি কর্পোরেশনের ভবন নির্মাণ/মেরামত, সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব ষ্টাফ কোয়াটার নির্মাণ ও সংস্কার, ঢাকায় সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব লিয়াঁজো অফিসের জন্য ফ্ল্যাট ক্রয়, কসাই খানা নির্মাণ/ময়লা আবর্জনা ফেলার জায়গা উন্নয়ন, সিটি কর্পোরেশনের যানবাহন রক্ষায় গ্যারেজ নির্মাণ, সিটি কর্পোরেশনের যানবাহন রক্ষণা-বেক্ষনে ওয়ার্কসপ নির্মাণ, হাট বাজার উন্নয়ন, বাস টার্মিনাল সংস্কার ও উন্নয়ন, সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পাঠাগার নির্মাণ, নাগরিক নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় সিসি ক্যামেরা স্থাপন, গভীর নলকুপ স্থাপন, এমজিএসপি প্রকল্পের রক্ষনা-বেক্ষন কাজের নিজস্ব অর্থ ব্যয়, সিটি কর্পোরেশনের জন্য জীপ গাড়ী ও ২টি আধুনিক এ্যাম্বুলেন্স ক্রয় এবং নারীদের উন্নয়নে প্রকল্প গ্রহণ ব্যয়সহ ইত্যাদি ব্যয় উল্লেখযোগ্য।

বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কুরআন থেকে তিলাওয়াত করেন সিসিক মসজিদের ইমাম ও খতিব মুফতি মাওলানা জসিম উদ্দিন।

গিতা পাঠ করেন সিসিক কর্মকর্তা জ‍্যুতিষ চক্রবর্তী ও বাইবেল পাঠ করেন ফিলিপ সমাদ্দর।

Sharing is caring!