স্টাফ রিপোর্টার:
ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা) ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি—জেপির নেতৃত্বে ছয়টি নিবন্ধিত দলসহ মোট ১৮টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)’ নামে নতুন একটি জোট আত্মপ্রকাশ করেছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর গুলশানে ইমানুয়েলস পার্টি সেন্টারে আয়োজিত সংবাদসম্মেলনে এই জোটের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়।
এনডিএফের প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় পার্টি—জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুখপাত্র জাপা মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার এবং প্রধান সমন্বয়ক জনতা পার্টি বাংলাদেশ (জেপিবি)-এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার মিলন।
জোটের শরিক দলগুলো হলো—জাতীয় পার্টি (জাপা), জাতীয় পার্টি—জেপি, জনতা পার্টি বাংলাদেশ (জেপিবি), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, গণফ্রন্ট, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জাতীয় ইসলামী মহাজোট, জাসদ (শাহজাহান সিরাজ), ডেমোক্রেটিক পার্টি, অ্যালায়েন্স ডেমোক্রেটিক পার্টি, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বাংলাদেশ স্বাধীনতা পার্টি, বাংলাদেশ স্বাধীন পার্টি, ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক পার্টি—ইউডিপি, জাতীয় সাংস্কৃতিক জোট ও গণআন্দোলন।
মানুষ জিডিপি ও মাথাপিছু আয় বোঝে না, বুঝতে চায় সে মুক্ত কিনা :আনোয়ার হোসেন মঞ্জু
জোট ঘোষণা উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদসম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় পার্টি—জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, স্বাধীনতার মৌলিক আকাঙ্ক্ষাই ছিল মানুষ একটি ভয়হীন পরিবেশে নিরাপদে বসবাস করবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য—এই ৫৪ বছরে যারাই ক্ষমতায় এসেছে, সবাই ভয় দেখানোর নীতি গ্রহণ করেছে। এক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এ দেশের সাধারণ মানুষ জিডিপি (প্রবৃদ্ধির হার) বোঝে না, পার ক্যাপিটা ইনকাম (মাথাপিছু আয়) বোঝে না; সে বোঝে সে মুক্ত কিনা, স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে কিনা। এটাই ছিল স্বাধীনতার মূল চাওয়া।
তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর কিছুই হয়নি, এটা সত্য নয়। এই ৫৪ বছরে অবকাঠামোগত যে পরিবর্তন হয়েছে, বিদেশিরা এবং যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ আশ্চর্য হয়ে যান—এটা কীভাবে সম্ভব হলো। ৬৮ হাজার গ্রামের সঙ্গে রাজধানীর সংযোগ স্থাপিত হয়েছে; গুলশান-বনানীসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এত উঁচু অট্টালিকা হলো। এমন কোনো গ্রাম নেই, যেখানে বৈদ্যুতিক বাতি নেই। তার মানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে আমরা ভুল করিনি। অথচ আমরা নিজেরাই নিজেদের অপমান করি, একে অন্যকে চোর বলি। ৫৪ বছরে যারাই ছিলেন, সবাই যদি চোর হয়ে থাকেন, তাহলে এত উন্নয়ন, এত কাজ কে করল?
জেপি চেয়ারম্যান বলেন, সব সরকারই এসে বলেন—কথা বলুন। কিন্তু, কথা বললেই বিপদে পড়তে হয়। বর্তমান সরকারও এসে বলল—মন খুলে কথা বলুন। কিন্তু, মন খুলে কথা বলা তো পরের বিষয়, একটু বললেও কী হয়! তাহলে কেন বললেন—মন খুলে কথা বলুন? চেয়ারে আছেন, যা খুশি বলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই চেয়ারে অতীতেও অনেকে ছিলেন, ভবিষ্যতেও অনেকে আসবেন; তখন তারাও একই ভাষায় কথা বলবেন। উপদেশ দেন, কথা বলেন; সমস্যা নেই। কিন্তু, কতটুকু পারি, কতটুকু পারি না—সেই সীমাবদ্ধতা মনে রাখা প্রয়োজন। তার পরও বলব, আশা নিয়েই আমাদের থাকতে হবে, হতাশ হওয়া যাবে না। কোনো অধিকার পাইনি তা বলব না। অধিকার না পেলে বাঙালিরা দিন-রাত এত কথা কী করে বলে। বাক্স্বাধীনতা নেই বলব না। কিন্তু, এই করে ফেলব, সেই করে ফেলব, এটা ভেঙে দেব—এসব কী ভাষা!
আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, ‘আমরা উদারপন্থি রাজনীতির লোক। আমরা নিরাপদে বসবাস করতে পারি না, নির্ভয়ে চলাফেরা করতে পারি না; কোন দেশে পারে? তবে হ্যাঁ ঐসব দেশে যেটা হয়, সেটা সহনীয় মাত্রার।’ তিনি বলেন, ‘আমরা একই ভাষার, একই সংস্কৃতির লোক। নিজেদের মধ্যে এত কিলাকিলি কেন? আমরা এত পরশ্রীকাতর কেন, কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না। এই দেশটা পরিচালনা সহজ ছিল। কিন্তু আমরা নিজেরাই সেটা কঠিন করে ফেলেছি। জীবনটাকে ইতিবাচকভাবে দেখতে হবে। কেউ কেউ আমলাতন্ত্র নিয়ে কথা বলেন। আমলাতন্ত্র লাগবে, কিন্তু আমরা নিজেরাই সেটাকে দুর্বল করে ফেলেছি। আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি তা বলব না। তবে, আরো ভালো করতে পারতাম। তাই বলে পাকিস্তান আমলেই ভালো ছিলাম—এ কথা বলা যাবে না।’
এভাবে চলতে থাকলে দেশে মবের নির্বাচন হবে :আনিসুল ইসলাম মাহমুদ
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বকারী ও জাপা চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ তার বক্তব্যে বলেন, কোন কোন দল দেশকে শাসন করবে, জনগণ কাকে বেছে নেবে—সেটা আগে থেকে বলে দেওয়ার এখতিয়ার কারো নেই। সরকারকে বলব—এখনো সময় আছে, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনেন, প্রশাসন ঠিক করুন। আমরা নির্বাচন চাই। যেখানে নিরাপত্তা নিয়ে তারেক রহমান সন্দিহান, সেখানে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়? এভাবে চলতে থাকলে দেশে একটি মবের নির্বাচন হবে। কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ দিল, হাজার-হাজার মানুষ পঙ্গু হলেন; এটাকে বৃথা যেতে দেবেন না। আমরা যদি আবারও ভুল করি, তাহলে পতিত ফ্যাসিস্ট আবার প্রতিষ্ঠিত হবে। কাজেই আমরা যদি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করি, তাহলে দ্রুত মিথ্যা মামলাসমূহ প্রত্যাহার করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, ৫৪ বছরে আমরা অনেক ভুল করেছি। ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে, যেন সামনে আর ভুল না করি। গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হলো নির্বাচন। অতীতে নির্বাচনে যে ভুল করেছি, সেখান থেকে শিক্ষা নিতে না পারলে জাতিকে আরো মাশুল দিতে হবে। আমরা সেই ভুল আর করতে চাই না। একটি পরিবর্তনের পর সরকারকে পালিয়ে যেতে হয়, সেই পরিস্থিতি আর চাই না। আমরা একটি সভ্য, সুন্দর ও গণতান্ত্রিক সমাজ চাই। এমন নির্বাচন করতে হবে যেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না।
ব্যারিস্টার আনিস বলেন, এখন এক দল আরেক দলের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। জুলাই আন্দোলনের পর একদল আরেক দলের অর্জন ও অতীত নিয়ে কথা বলছে। আমরা আর অতীত নিয়ে থাকতে চাই না, ভবিষ্যত্ নির্মাণ করতে চাই। কীভাবে দেশ উন্নত হবে, মানুষের কর্মসংস্থান হবে—তা নিয়ে কাজ করতে হবে। বিভেদের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। একের পর এক ভুলের মাশুল আমরা দিয়ে যাচ্ছি। এতদিন আমরা যে ভুলের ভেতর দিয়ে গিয়েছি সেটা যেন আর না হয়।
জাপা চেয়ারম্যান আরো বলেন, সামনে নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন কয়দিন পরপরই বলছে, প্রস্তুতি শেষ। সরকার উত্সবমুখর ও ঐতিহাসিক নির্বাচনের কথা বলছে। সরকারের অফিসে ও নির্বাচন কমিশনের ভেতরে কী হচ্ছে জানি না, তবে বাইরে এর কোনো প্রতিফলন দেখছি না। অসংখ্য মানুষ সন্দেহ করছে—ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি না। যার সঙ্গে দেখা হয় সেই এই প্রশ্ন করে। কারণ দেশে এখনো মব কালচার বন্ধ হয়নি।
নতুন জোটের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যারিস্টার আনিস বলেন, এটা কেবল নির্বাচনি জোট নয়। যদিও সামনে নির্বাচন, এটা একটি রাজনৈতিক জোট। ভবিষ্যতে রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে আমরা শরিকরা একসঙ্গে কাজ করব। কারণ জাতীয়ভাবে যে বিভাজন, সেটার ভিত্তিতে দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা দেশকে নতুন রাজনীতি দিতে চাই। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই জোটে ছয়টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। আরো অনেকের সঙ্গে কথা হচ্ছে। যিনিই যোগ্য, তিনি তার দলের মনোনয়ন না পেলেও আমাদের সঙ্গে আসলে আমরা সেটা বিবেচনা করে দেখব।
সবাইকে নিয়ে নির্বাচন না হলে নতুন সরকার টেকসই হবে না: রুহুল আমিন হাওলাদার
জাপা মহাসচিব ও ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)’-এর মুখপাত্র এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, রাজনীতি আজ ক্রান্তিলগ্নে। আমরা সবসময়ই নির্বাচনমুখী দল। সব নির্বাচনেই আমরা ছিলাম। প্রধান উপদেষ্টা ও অন্তর্বর্তী সরকারকে বলব— সবাইকে নিয়ে নির্বাচন আয়োজন করুন। কাউকে কাউকে বাইরে রেখে নির্বাচন হলে নতুন সরকার টেকসই হবে না। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। কারা সরকার গঠন করবে সেই রায় দেবে জনগণ। তিনি বলেন, নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকতে হবে। নইলে এনডিএফ নির্বাচনে যাবে কি না, তা ভেবে দেখবে।
জাপার কো-চেয়ারম্যান মোস্তফা আল মাহমুদের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে জাপার সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আমরা নির্বাচন চাই। তবে সেটা হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য। জাপার নির্বাহী চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, নির্বাচনের সত্যিকারের পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। এনডিএফের প্রধান সমন্বয়ক ও জেপিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গোলাম সারোয়ার মিলন বলেন, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে নতুন এই জোটের আত্মপ্রকাশ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। মহান একাত্তরের চেতনা ও জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধের আদর্শে এই জোট পরিচালিত হবে। নতুন জাগরণের মাধ্যমে বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়াই এই জোটের অন্যতম লক্ষ্য।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাপার কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, সাহিদুর রহমান টেপা, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, লিয়াকত হোসেন খোকা, জহিরুল ইসলাম জহির, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি শাহ মো. আবু জাফর, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের সভাপতি আবু লায়েস মুন্না, তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব মেজর অবসরপ্রাপ্ত ডা. হাবিবুর রহমান, গণফ্রন্টের মহাসচিব আহমেদ আলী শেখ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মহসিন রশিদ, জাতীয় ইসলামী মহাজোটর চেয়ারম্যান আবু নাসের এম ওয়াহেদ ফারুক, জাতীয় সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি মেজর অবসরপ্রাপ্ত আমীন আহমেদ আফসারি, ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান এম আশিক বিল্লাহ, অ্যালায়েন্স ডেমোক্রেটিক পার্টি-এডিপির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম আর করিম, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ারম্যান এম আর এম জাফর উল্লাহ চৌধুরী, বাংলাদেশ স্বাধীনতা পার্টির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজু, বাংলাদেশ স্বাধীন পার্টির চেয়ারম্যান মির্জা আজম, ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান নারায়ণ কুমার দাস প্রমুখ।