Beanibazarer Alo

  সিলেট     শনিবার, ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ  | ২১শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পাথারিয়ার বনে কেন পুরুষ হাতি ছাড়তে চায় বন বিভাগ

admin

প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২৫ | ০৬:৫৫ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৫ | ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
পাথারিয়ার বনে কেন পুরুষ হাতি ছাড়তে চায় বন বিভাগ

Manual1 Ad Code

স্টাফ রিপোর্টার:

বৃহত্তর সিলেটের পাহাড়ি বনাঞ্চলে একসময় হাতির চলাচল ছিল নিত্যদৃশ্য। কিন্তু গত কয়েক দশকে এ অঞ্চলের হাতির দল প্রায় হারিয়ে গেছে। এখন শুধু মৌলভীবাজারের পাথারিয়া বনে তিনটি নারী হাতির হদিস পাওয়া যায়। একমাত্র পুরুষ হাতিটি ২০১২ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে মারা যাওয়ার পর থেকেই পাথারিয়া বনে হাতি বিলুপ্তির আশঙ্কা তৈরি হয়।

তাই হাতি প্রজননের সম্ভাবনা বাড়াতে বন বিভাগ পাথারিয়ার বনে এবার একটি পুরুষ হাতি ছাড়ার পরিকল্পনা নিয়েছে।

হাতির সংখ্যা ও সংকট

২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণের জোট আইইউসিএন হাতিকে মহাবিপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। পরের বছর জরিপ চালিয়ে দেশে ২৬৭টি বন্য হাতির অস্তিত্ব পায় আইইউসিএন। এদের বড় অংশ দেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রাঙামাটির পাহাড়ি বনে টিকে আছে।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ বছরে দেশে মারা গেছে ১৪৮টি হাতি। যোগাযোগ অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পে বনভূমি অধিগ্রহণ, বনভূমির অবৈধ দখল এবং কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার বনভূমিতে রোহিঙ্গা শিবির স্থাপন—এসব কারণ এশীয় হাতির অস্তিত্বের সংকট বাড়িয়েছে।

Manual5 Ad Code

পুরুষ হাতি ছাড়ার উদ্যোগ

পাথারিয়া বনে পুরুষ হাতি ছাড়তে বন বিভাগ গত ১৪ আগস্ট বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটিকে ছয়টি করণীয় নির্ধারণ করে দিয়ে ২১ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। তবে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও প্রতিবেদন জমা পড়েনি।

এর আগে বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ, বন কর্মকর্তা এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল পুরুষ হাতি ছাড়ার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে গত মে মাসে পাথারিয়ার সংরক্ষিত বন পরিদর্শন করেছে।

এই দলের তৈরি করা এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১২ সালে বিএসএফের গুলিতে এ বনের একমাত্র পুরুষ হাতিটির মৃত্যু হয়। আর টিকে থাকা তিনটি নারী হাতির মধ্যে একটি অসুস্থ ও দুর্বলতার কারণে দলছুট হয়ে পড়েছে।

এই দলের সদস্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ বলেন, ১৯৭৮ সালের দিকে পাথারিয়ার সংরক্ষিত বনে হাতির সংখ্যা ছিল ১৮। একমাত্র পুরুষ হাতিটি বিএসএফের গুলিতে মারা গেছে। এখন টিকে আছে মাত্র ৩টি মাদী হাতি।

পাথারিয়ার হাতিগুলো ট্রান্সবাউন্ডারি, অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে চলাচল করে জানিয়ে এম এ আজিজ বলেন, ‘তাই এখানে কোনো পুরুষ হাতি ছাড়তে হলে তা ভারতের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে করতে হবে।’

আন্তর্জাতিক মতপার্থক্য

সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ‘এশিয়ান এলিফ্যান্ট স্পেশালিস্ট গ্রুপের’ বৈঠকে পাথারিয়ার সংরক্ষিত বনে পুরুষ হাতি ছাড়ার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। অধ্যাপক এম এ আজিজ বলেছেন, সেখানে শ্রীলঙ্কার বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা উদ্যোগটিকে স্বাগত জানালেও ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা আপত্তি তোলেন।

বন বিভাগের নথি বলছে, পাথারিয়ার সংরক্ষিত বনটি ভারতের আসাম রাজ্য–সংলগ্ন। তিন দশক আগেও আসামের বনাঞ্চল থেকে এক দল হাতি নিয়মিত পাথারিয়ার বনে যাতায়াত করত। পরে ভারত সীমান্তে কাঁটাতার নির্মাণ করলে এ সংখ্যা কমে আসে।

Manual1 Ad Code

মৌলভীবাজারভিত্তিক বন্য প্রাণী সংরক্ষণবিষয়ক সংগঠন ‘স্ট্যান্ড ফর আওয়ার এনডেনজারড ওয়াইল্ডলাইফের’ প্রতিষ্ঠাতা সোহেল শ্যাম  বলেন, হাতির বিলুপ্তি ঠেকাতে এটি ইতিবাচক একটি উদ্যোগ। তবে পুরুষ হাতি ছাড়া হলে সেটার প্রভাব কী পড়বে, নারী হাতি কীভাবে পুরুষ হাতিকে গ্রহণ করবে, এ রকম বৈশ্বিক কোনো উদাহরণ আছে কি না, সব বিবেচনায় নিয়ে এটা করতে হবে।

সোহেল আরও বলেন, এসব প্রটোকল মানা না হলে আবার অন্য ধরনের সমস্যা দেখা দেবে। উদ্যোগটি সফল হলে হাতিগুলো সংরক্ষণ কীভাবে করা হবে, সে বিষয়ে পরিকল্পনা থাকতে হবে। বনে তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার নিশ্চিত করা, হাতি-মানুষ সংঘাত যে কয়েকটি জেলায় দেখা যায়, সেগুলোয় কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, এসব বিবেচনায় নিয়ে এগোতে হবে।

Manual2 Ad Code

বন বিভাগের অবস্থান

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বন বিভাগের অধীনে থাকা দেশের দুটি সাফারি পার্কের যেকোনো একটি থেকে হাতি নিয়ে তা পাথারিয়ার বনে ছাড়ার পরিকল্পনা আছে বন বিভাগের।

Manual7 Ad Code

বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মো. ছানাউল্যা পাটওয়ারী  বলেন, চার মাস ধরে হাতি তিনটিকে আর পাথারিয়ার বনে দেখা যাচ্ছে না। এগুলো ভারত আর বাংলাদেশে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে।

এরই মধ্যে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে জানিয়ে এই বন সংক্ষক বলেন, এ তিনটি হাতি মূলত আধা গৃহপালিত। মালিক মারা গেলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। পরিকল্পনা আছে সাফারি পার্ক থেকে যেকোনো একটা পুরুষ হাতি এখানে ছাড়া হবে। তবে ছাড়ার পর ফলাফল কী হচ্ছে, তা জানতে দীর্ঘসময় ধরে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে এশীয় হাতি

আইইউসিএন বলছে, বাংলাদেশে হাতি মহাবিপন্ন হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও ভারতে তা বিপদাপন্ন। এর অর্থ বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে হাতির অবস্থা ও সংখ্যা ভালো। ভারতে বর্তমানে ২০ থেকে ২৫ হাজার হাতি আছে। আর বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা ২৬৭।

বিশ শতকের শুরুতে এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে—পারস্য উপসাগর থেকে ভারত ও চীন পর্যন্ত, একসময় এক লাখেরও বেশি এশীয় হাতি বিচরণ করত। কিন্তু গত তিন প্রজন্মে তাদের সংখ্যা অন্তত ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এখন বিশ্বের বড় অংশে মানুষ বাস করছে হাতির আবাসস্থলের ভেতরে বা আশপাশে। আবাসস্থল ধ্বংস ও খণ্ডিত হওয়া, শিকার ও বন্য হাতি বেচাকেনা—সব মিলিয়ে হাতির টিকে থাকা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে।

 

শেয়ার করুন