Beanibazarer Alo

  সিলেট     বুধবার, ১৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ  | ২রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পিলখানার দুঃসহ স্মৃতির ১৫ বছর

admin

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১০:৫২ পূর্বাহ্ণ | আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১০:৫২ পূর্বাহ্ণ

ফলো করুন-
পিলখানার দুঃসহ স্মৃতির ১৫ বছর

Manual7 Ad Code

স্টাফ রিপোর্টার:
পিলখানায় বার্ষিক ‘দরবার’ চলছিল। শুরুতেই উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখেন বেশ কয়েকজন তৎকালীন বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) জওয়ান। তাদের বক্তব্যের ভাষা ছিল ঝাঁঝালো। তারা চান সেনা কর্মকর্তাদের মতো সমান অধিকার। এরপরই বক্তব্য রাখেন তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর শাকিল আহমেদ।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির এই দিনে সেই দরবারে তৎকালীন মহাপরিচালকের বক্তব্যেও হিসেব মেলেনি। মহাপরিচালকসহ অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মিলনায়তনের অভ্যন্তরে জিম্মি করেন জওয়ানরা। চালান গুলি। সূচনা হয় ‘বিডিআর বিদ্রোহ’ নামে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের।

তাৎক্ষণিক পিলখানার গুলির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলাদেশে। পিলখানার সে আতঙ্ক ভর করে প্রতিটি বাঙালির প্রাণে। টেলিভিশন সেটের সামনে বসা অনেকেই সেদিন প্রার্থনা করে বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আমাদের সেনা সদস্যদের মুক্ত কর, তাদের জীবিত ফেরত দাও’। কিন্তু নির্দয় জওয়ানরা একে একে বুক ঝাঁজরা করে হত্যা করেন ৫৭ সেনা সদস্যকে। ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি চলা এ বিদ্রোহে মোট ৭৪ জন প্রাণ হারান।

আজ থেকে ১৫ বছর আগে এই দিনে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম জঘন্যতম এ ঘটনা ঘটে ঢাকার পিলখানায় বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদরদপ্তরে।

পিলখানা ট্রাজেডির ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি কোনো মামলার। এ নিয়ে করা দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলার বিচার আপিল বিভাগে শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ। ২০১১ সালে শুরু হওয়া বিস্ফোরক আইনের মামলার বিচার ঢাকার আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।

হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের পর ছয় বছরে সর্বোচ্চ আদালতে শুনানি হয়নি। তবে এ বছরের মধ্যে আপিল শুনানি শুরু হতে পারে বলে আশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ।

আসামিপক্ষের প্রত্যাশা, আপিল বিভাগে বিচারক বাড়িয়ে আলাদা বেঞ্চ গঠন করে দ্রুত শুনানির ব্যবস্থা হবে।

সকাল ৯টা ২৭ মিনিটের দিকে বিডিআরের বার্ষিক দরবার চলাকালে দরবার হলে ঢুকে পড়েন এক দল বিদ্রোহী সৈনিক। তাদেরই একজন তৎকালীন মহাপরিচালকের (শাকিল আহমেদ) বুকে বন্দুক তাক করেন। সূচনা হয় ইতিহাসের সেই নৃশংসতম ঘটনার। বিদ্রোহী সৈনিকরা সেনা কর্মকর্তাদের উপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করে পরিবারকে জিম্মি করে ফেলেন জওয়ানরা। পুরো পিলখানায় সৃষ্টি হয় ভীতিকর পরিস্থিতি। চারটি প্রবেশ গেট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশপাশের এলাকায় গুলি ছুঁড়তে থাকেন বিদ্রোহীরা।

তারা দরবার হল ও এর আশপাশের এলাকায় সেনা কর্মকর্তাদের উপর গুলি করতে থাকেন। তাদের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়তে থাকেন সেনা কর্মকর্তারা। ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান হয়। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। পরে পিলখানার ভেতরে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের মরদেহ। ৩৬ ঘণ্টার এ হত্যাযজ্ঞে ৫৭ সেনা কর্মকর্তা, এক সৈনিক, দুই সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ বিজিবি সদস্য ও পাঁচ বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন।

বহুল আলোচিত এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় (পিলখানা হত্যা মামলা) ১৩৯ জনকে ফাঁসি, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন ও ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা হিসেবে পরিচিত এটি। দীর্ঘ বিচার ও রায় শেষে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পিলখানা হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।

Manual2 Ad Code

আদালত সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়।

হত্যা মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় আসামির সংখ্যা বেড়ে হয় ৮৫০ জন। এছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

রাজধানীর পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ইতিহাসের কলঙ্কজনক এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন, ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে (তিন বছর থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত) কারাদণ্ড, ২৭৮ জনকে খালাস এবং চার আসামি বিচার চলাকালে মারা যাওয়ায় তারা অব্যাহতি পান।

Manual7 Ad Code

আদালতের রায় ঘোষণার পর ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে যায়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আসামিরা দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল ও জেল আপিল করেন। এর মধ্যে ৬৯ জনকে খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। গুরুত্বপূর্ণ এ মামলার শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্ট বিশেষ উদ্যোগ নেন।

Manual4 Ad Code

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির জন্য বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে দেন। দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের উপর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে শুনানি শুরু হয়।

মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিতরা সবাই বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (তৎকালীন বিডিআর) সদস্য ছিলেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিতদের মধ্যে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীও রয়েছেন। এর মধ্যে নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ২০১৫ সালের ৩ মে রাজশাহী কারাগারে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

হাইকোর্টের রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ জন আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন। একইসঙ্গে আটজনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেওয়া হয়।

এছাড়া বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জন আসামির মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এদের মধ্যে দুজন আসামির মৃত্যু হয়েছে এবং ১২ আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।

পিলখানায় এই বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। শুরু হয় বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ। বিডিআরের নাম, পোশাক, লোগো ও সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। বিডিআরের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পরিবর্তন করা হয় তাদের আইন।

দিনটিকে ঘিরে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর বা আইএসপিআর থেকে জানানো হয়েছে, নিহত সেনা সদস্যদের স্মরণে শাহাদাতবার্ষিকী হিসেবে এদিন সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে সেনাবাহিনী।

Manual3 Ad Code

সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে ২০০৯ সালে সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সেনা সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এছাড়া এদিনটি স্মরণে রোববার ও সোমবার (২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি) নানা কর্মসূচি পালন করার কথা রয়েছে বিজিবির।

শেয়ার করুন