Beanibazarer Alo

  সিলেট     বৃহস্পতিবার, ১৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ  | ৩রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ফুটবলার রাজিয়ার জন্য আমরা কে কী করেছি

admin

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৪ | ০১:৫৫ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৪ | ০১:৫৫ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
ফুটবলার রাজিয়ার জন্য আমরা কে কী করেছি

Manual6 Ad Code

স্টাফ রিপোর্টার:
পরিবারের ভাষ্য, রাজিয়া সুলতানার প্রসববেদনা উঠেছিল ১৩ মার্চ বেলা তিনটার দিকে। রাত সাড়ে ১০টায় সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রাজিয়াকে মৃত ঘোষণা করে রাত তিনটার দিকে। ১২ ঘণ্টার মধ্যে সব শেষ।

Manual5 Ad Code

রাজিয়ার মৃত্যুর কারণ কী? সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে-পরে আঁতুড়ঘরে উপস্থিত ছিলেন রাজিয়ার মা আবিরন বেগম। আগেই বলেছি আবিরন জন (দিনমজুরি) খাটেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন। তাঁর কাছে জানতে চাই, মেয়ের অবস্থা যে এত খারাপ, বোঝেননি? জবাবে তিনি বলেন, ‘বাচ্চা বাইর হয়ে এসেছে, ফুল পইড়ে গেছে, তা আর কী চিন্তা! এই দুটো নিয়েই তো যত দুশ্চিন্তা।’

রাজিয়ার স্বামী ইয়াম রহমান সন্তান ভূমিষ্ঠের সময় স্ত্রীর পাশে ছিলেন না। মৃত্যুর পর শিশুটিকে নিয়ে গেছেন। এর আগে তিনি বলেন, স্ত্রীর সন্তান হবে বলে তিনি আগেই টাকা পাঠিয়ে রেখেছিলেন। ছুটি পাননি বলে আসতে পারেননি। রাজিয়ার মৃত্যুর জন্য তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন দায়ী।

রাজিয়ার পরিবারের কাছ থেকে গর্ভাবস্থায় করা দুটি আলট্রাসাউন্ড রিপোর্ট, আর একটি টিকার কার্ড ছাড়া কিছু পাওয়া যায়নি। এই সম্বল করে ২০ মার্চ সহকর্মী কল্যাণ ব্যানার্জীকে নিয়ে এবার আমাদের গন্তব্য সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ। কলেজের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের প্রধান শংকর প্রসাদ বিশ্বাস শুরুতেই বলেন, ‘এমন একটা বিষয় নিয়ে জানতে চাইছেন, যার কিছুই আমি জানি না। ধারণা করি, রাজিয়ার মৃত্যু হয়েছে প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণে।’ পরিবার তো বলছে, রাজিয়া সুস্থ ছিল। জবাবে তিনি বললেন, ‘মানবদেহে ৫ লিটার রক্ত থাকে। প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণে পাঁচ মিনিটে দুই লিটার রক্ত বেরিয়ে যেতে পারে। খুব দ্রুত এ সময় রোগীর অবস্থা খারাপ হয়।’

আমরা সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের আরেকজন স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলি। রাজিয়ার দুটি আলট্রাসাউন্ড রিপোর্ট তাঁকে দেখাই। চিকিৎসক বললেন, ‘একদম ঠিক আছে। প্রথম রিপোর্টে বাচ্চা পেটের ভেতর উল্টে আছে, কিন্তু সর্বশেষ রিপোর্টে বাচ্চার পজিশন (অবস্থান) ঠিক আছে।’ তাঁরও ধারণা, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রাজিয়ার মৃত্যু হয়েছে। বাসায় সন্তান প্রসবই কি এর কারণ? চিকিৎসকের ধারণা তা-ই। তিনি বলেন, বিদেশেও বাসায় সন্তান প্রসব হয়, একেবারে যে হয় না, তা নয়। সে ক্ষেত্রে সন্তানসম্ভবা মা একজন স্বাস্থ্যকর্মীর সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে থাকেন। স্থানীয় হাসপাতালও অবহিত থাকে।

রাজিয়া কি কোনো স্বাস্থ্যকর্মীর তত্ত্বাবধানে ছিলেন? নিশ্চয়ই না। অদক্ষ ধাত্রীর হাতে তাঁর সন্তান জন্ম নেয়। এই ধাত্রীরা কিছু পারুক না পারুক, ‘ব্যথা ওঠানোর’ জন্য স্যালাইনে ইনজেকশন দিয়ে থাকেন। এতেও সর্বনাশ হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে মাঠপর্যায় পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা দুই বিভাগেরই। তাঁরা কী ভূমিকা রেখেছেন? রাজিয়া অস্ত্রোপচারের ভয় পাচ্ছিলেন। ঠিকই তো, অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার হচ্ছে। এসব ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানকে চলতে দিচ্ছে কারা, কিসের বিনিময়ে? একনাগাড়ে অনেকক্ষণ কথা বলে থামলেন চিকিৎসক।

সত্যিই তো! যত দূর জানা যাচ্ছে রাজিয়া একবারই স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে গিয়েছিলেন। মৌতলায় একটা স্বাস্থ্যশিবিরে ইতিয়ারা নামের এক কর্মী তাঁকে টিকা দিয়েছিলেন। এই পর্যন্তই। যদিও কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কর্মকর্তা মো. বুলবুল কবীরবলেন, তাঁর হাসপাতালে শতভাগ স্বাভাবিক প্রসব হচ্ছে। এই খবর কেন যায়নি রাজিয়ার কানে? এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।

নিয়ম অনুযায়ী পরিবার পরিকল্পনা সহায়িকা রাজিয়া সুলতানার বাসায় যাওয়ার কথা। তিনি কি গিয়েছিলেন? পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তার মুখোমুখি আমরা। তাঁরা কিছুতেই নাম বলবেন না। ইদানীং কথা বললেই, ‘দেন অ্যান্ড দেয়ার’ বদলি হচ্ছে, তাই তাঁরা ঝুঁকি নিতে চান না​। সে যাক। তাঁরা কি জানতেন জাতীয় ফুটবল দলের একজন খেলোয়াড় মৌতলায় সন্তানসম্ভবা? তাঁদের পরিবার পরিকল্পনা সহায়িকা কি গিয়েছিল রাজিয়ার বাসায়? কর্মকর্তাদের মুখ থেকে দুই ধরনের ভাষ্য পাওয়া গেল। এক. পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের দম্পতি নিবন্ধন খাতায় রাজিয়ার নাম নেই। তিনি রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে বিয়ে করেছেন। ওখানকার দম্পতি। দুই. পরিবার পরিকল্পনা সহায়িকা রাজিয়ার বাসায় গিয়েছিলেন দুবার।

কর্মকর্তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল, তার মানে কেউ অন্য এলাকার বাসিন্দা হলে প্রসূতিসেবা পাবেন না? আর পরিবারকল্যাণ সহায়িকা যদি রাজিয়াদের বাসায় গিয়েই থাকে, তাঁর নোটে কী লেখা ছিল? রাজিয়া গর্ভাবস্থায় চারবার চেকআপ করাননি, কিংবা তিনি বাসায় সন্তান প্রসব করাতে ইচ্ছুক? এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়নি তাঁদের কাছে।

হতাশ হয়ে বললাম, ক্ষমা করবেন। একটা কথা না বলে পারছি না। আপনাদের অফিসের ভেতরের চাকচিক্য বেড়েছে, পোস্টার টানানো আছে ভেতরে। সাতক্ষীরা থেকে কালীগঞ্জ হয়ে মৌতলা যাওয়ার পথে কোথাও পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক কোনো পোস্টার চোখে পড়ল না। অথচ এই আমিই তিন দশক আগে স্কুলে যাওয়ার পথে গর্ভবতী মায়েদের সেবাসংক্রান্ত কত পোস্টার দেখেছি! মনে মনে ভাবি এত ঠাটবাট দিয়ে কী হবে, যদি রাজিয়ার মতো একজন জাতীয় সম্পদেরই কাজে না আসে?

স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ আসলে রাজিয়ার মৃত্যুর পর নড়েচড়ে বসে। তারা দল বেঁধে রাজিয়ার বাসায় যায়। রাজিয়ার একরত্তি ছেলেকে কোলে নিয়ে ছবি তোলে। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ভিডিও করেন। রাজিয়া যখন বেঁচে ছিলেন, তখন কেউ আসেননি। শুধু যে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগই রাজিয়ার মৃত্যুর পর জেগে উঠেছে, ব্যাপারটা এমনও নয়। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা প্রশাসনের ভূমিকাও রীতিমতো হতাশাজনক।

কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাঈদ মেহেদির কাছে প্রশ্ন ছিল, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব, ক্রীড়া, শিক্ষা-সংস্কৃতি ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তাঁর কতটা যোগাযোগ। জবাব ছিল, ভালো। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে স্থানীয় গুণী ব্যক্তিদের দাওয়াত দেওয়া হয়। যেমন? দু-চারজনের নাম বলবেন? উত্তরে বললেন, ‘যেমন আমার ভাইগ্নে জব্বার। সে একজন এডিসি।’ কখনো রাজিয়ার খোঁজ নিয়েছেন? বললেন, ‘আহারে! মেয়েটা শুধু আমার উপজেলার ছিল না, আমাদের একই ইউনিয়নে বাড়ি।’ ও যে সন্তানসম্ভবা, খুব অর্থকষ্টে আছে জানতেন? তিনি বললেন, জানতেন না। মৃত্যুর পর ওদের বাড়িতে গিয়ে সব শুনেছেন।

Manual6 Ad Code

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপংকর দাশ আরও এগিয়ে। তিনি বলেন, কেউ সাহায্য চাইলে তাঁরা এগিয়ে যান। আলাদাভাবে খোঁজখবর করার কোনো নির্দেশনা নেই।

জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমানও ছিলেন অন্ধকারে। তবে তিনি আফসোস করছিলেন খুব।

বুঝলাম, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে জাতীয় দলের ফুটবলার রাজিয়া সুলতানা দাম পেয়েছেন মৃত্যুর পর। শুধু স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কথাই-বা বলি কীভাবে? বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) রাজিয়ার জন্য কী করেছে? গর্ভাবস্থায় কোনো খোঁজখবর, অর্থ, খাদ্যসহায়তা, খেলায় ফেরার আশ্বাস? কিছুই না। অথচ এই রাজিয়ারাই না গোটা জাতিকে নিয়মিত আনন্দে ভাসিয়েছেন? তাঁদের জন্য আমাদের কি কিছুই করার ছিল না? কিছুই করার নেই?

জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলি। তিনি বললেন, ‘উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা ফুটবল খেলে না। যারা খেলতে আসছে, তাদের বলতে গেলে শতভাগ হতদরিদ্র পরিবারের। তাদের ঠিকমতো খাবার জোটে না। সরকারিভাবে আমি তিনটি টুর্নামেন্ট আর সাতটা প্রতিযোগিতার টাকা পাই। সর্বোচ্চ চেষ্টা করি ওই সময়টায় বাচ্চাদের একটু ভালো খাবার দিতে।’

জানা গেল, সাতক্ষীরা থেকে বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দলে জেলার বেশ কটি মেয়ে খেলছে। সমাজের ট্যাবু ভেঙে এই মেয়েদের তুলে আনার চেষ্টা করছেন দু-একজন ক্রীড়ামোদী। রাজিয়ারও সুযোগ হয়েছিল তেমনি এক সংগঠক আকবর আলীর সান্নিধ্যে আসার। তাঁর মৃত্যুর পর এই ধারা অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করছেন আরিফ হাসান।

আরিফ বললেন, ‘মেয়েদের নিজের বাসায় এনে রাখার চেষ্টা করি। খুব যে যত্ন করতে পারি, তা না। ধরেন, বাজারের তরি-তরকারিওয়ালাদের বলি, ভাই ওরা ফুটবল খেলে, সাত দিনের তরকারি সহায়তা যদি করতেন। কেউ আবার হয়তো ডাল দিয়ে সাহায্য করল। এভাবেই কোনোরকমে চলছে।’

দেশে কত কোটিপতি, শতকোটিপতি, হাজার কোটিপতির উত্থান হলো, তাঁদের মধ্যে কয়জন এগিয়ে এলেন এই মেয়েদের জন্য?

আমি এবার আমার নিজের দিকে তাকালাম। এই তো সেদিন ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এক রিপোর্ট সহকর্মী নাইর ইকবালকে দিয়ে বলেছিলাম দারুণ রিপোর্ট। ও দেশে খেলোয়াড়দের শরীরের আলাদা অঙ্গপ্রত্যঙ্গের জন্য আলাদাভাবে ইনস্যুরেন্স করা থাকে।

Manual5 Ad Code

ওদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা দেখেছেন, সাদারা এই ইনস্যুরেন্স থেকে যত টাকা তুলে নিতে পেরেছেন, কালোরা পারেননি। সে কী উত্তেজনা আমার। অথচ আমার দেশের সোনার মেয়েরা অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্ম দিলে খেলায় ফিরতে পারবেন না, এই শঙ্কা থেকে গর্ভাবস্থার কথা গোপন করে যান। গর্ভাবস্থায় খেলতে নামেন। তারপর দুম করে মরে যান। এই নিয়ে আমি কখনো ভাবিনি।

Manual4 Ad Code

১৭ কোটি মানুষের দায় কাঁধে নিয়ে যে ১১টি মেয়ে মাঠে নামে, তাদের জন্য আমরা আসলে কী করলাম? (শেষ)

শেয়ার করুন