বাংলাদেশ ঋণের জন্য বারবার চীনের দ্বারস্থ হয় কেন?
০৮ জুলা ২০২৪, ০১:৩২ অপরাহ্ণ
স্টাফ রিপোর্টার:
চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের আমন্ত্রণে চার দিনের সফরে আজ (সোমবার) চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের চীন সফরে দু দেশের মধ্যে কোনও চুক্তি হচ্ছে না, তবে ২০টির মতো সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পাশাপাশি কিছু প্রকল্পের উদ্বোধন হতে পারে।
যে সব বিষয়ে সমঝোতা হবে তার কোনও আর্থিক মূল্যের কথা না জানালেও মন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক এখন ‘দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে’।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছেন, বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে প্রায় পাঁচশ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার বিষয়ে বেইজিংয়ের দিক থেকে ঘোষণা আসতে পারে এবং এই ঋণ চীনা মুদ্রায় দেওয়ার ওপরই জোর দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
শেখ হাসিনা এর আগে ২০১৪ সালে ও ২০১৯ সালে চীন সফর করেছেন। আর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৬ সালে ঢাকা সফরে এসেছিলেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সাধারণত বড় বড় প্রকল্প কিংবা অর্থনৈতিক সংকটের সময় চীনের কাছ থেকেই গত দেড় দশক ধরে সহায়তা পেয়ে আসছে এবং অধিকাংশ বড় প্রকল্পের অর্থ যোগানের ক্ষেত্রে এখন চীনকেই বিবেচনা করে থাকে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ঋণ বা অর্থ সহায়তার জন্য বারবার চীনের দ্বারস্থ হয় কেন? বিষয়টি নিয়ে সোমবার (৮ জুলাই) প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।
অর্থের জন্য চীন কেন গুরুত্বপূর্ণ
গত এক দশক ধরে ছোট বড় নানা প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার। চীনের অর্থায়নে চট্টগ্রাম টানেল নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করেছে চীনা কোম্পানি। প্রায় শেষ হয়েছে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট’ বা এইআই গত বছর যে ধারণা দিয়েছিল তাতে বাংলাদেশে মোট চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল সাত বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
এছাড়া চীনের কয়েকটি কোম্পানি বিভিন্ন খাতে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলারের নির্মাণ কার্যাদেশ পেয়ে কাজ সম্পন্ন করেছে কিংবা এখনও করছে।
বাংলাদেশের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও এখন সংসদের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির প্রধান আব্দুল মান্নান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, চীনের কাছ থেকে আর্থিক বা প্রকল্পগত সহায়তা চাওয়ার কারণ হলো চীন কখনও ‘অন্যের ওপর কিছু চাপিয়ে দেয় না’। চীন উদীয়মান বিশ্ব সেরা অর্থনীতি। এশীয় প্রতিবেশী হিসেবে আমরা আরও বন্ধুত্বের পক্ষে। যে কোনো চুক্তি বা সমঝোতায় বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকে। তাই চীনের সাথে বন্ধুত্ব গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত রাজনৈতিক যোগাযোগ, অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার কারণেই বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে চীনা সহায়তা চেয়ে থাকে।
সুদের হার ও খরচ কম
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, সুদের হার, শর্ত, প্রযুক্তি এবং কম খরচ হবে – এসব চিন্তা করেই বাংলাদেশ প্রকল্পগুলোর জন্য চীনের সহায়তা প্রত্যাশা করে।
তিনি বলেন, প্রথমত ঋণটা সহজে পাওয়া যায়। অন্য দাতা সংস্থাগুলোর মতো দুই শতাংশ সুদেই ঋণ দেয় চীন। আর কষ্ট বেনিফিট বিবেচনায় নিলে যেখান থেকে ঋণ পেলে সুবিধা সেদিকেই তো যাব আমরা। সে জন্যই চীন গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরও বলেন, তার মতে অবকাঠামো উন্নয়ন-সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর জন্য চীনের প্রযুক্তি বা খরচ অন্য দেশের তুলনায় কম হয়। তা ছাড়া দেখতে হবে অর্থ দেওয়ার সক্ষমতা কার আছে। উপকরণের দাম কে কম নিবে। চীনের কাছে যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত অর্থ আছে তা আর কারও কাছে নেই।
মুন্সী ফয়েজ বলেন, চীন এখন অনেক সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে। তাদের ঋণের ধরনেও আমরা অভ্যস্ত হয়েছি। সে কারণেই তাদের অফার বাংলাদেশ বিবেচনা করে। তারা প্রযুক্তি ও অর্থ উভয় ক্ষেত্রেই সক্ষম। আর গুরুত্বপূর্ণ হলো চীন তাদের নিজেদের প্রযুক্তি চাপিয়ে দেয় না। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় তারা বিনিয়োগ করছে যেখানে ঠিকাদার তাদের কিন্তু প্রযুক্তি অন্য দেশের।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান এইড ডাটার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়েছিল।
কিন্তু ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। এখন চীনই বাংলাদেশের জন্য একক বৃহত্তম ঋণদাতা দেশ।
গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়ে ২৩০ কোটি ডলার ঋণ কিংবা সহায়তা নিয়েছে চীনের কাছ থেকে। একটি হিসেবে দেখা যাচ্ছে, গত চার বছরে বাংলাদেশে তিন বিলিয়ন ডলার সহায়তা এসেছে চীন থেকে।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরেও একটি মেট্রোরেল রুট-সহ আরও কয়েকটি রেলওয়ে প্রকল্প এবং কয়েকটি সেতু নির্মাণ বা সংস্কারের বিষয়ে সমঝোতা হবে বলে বাংলাদেশ আশা করছে।
তবে বহুল আলোচিত তিস্তা প্রকল্পের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বিষয়টি চীন আলোচনায় নিয়ে আসলে এ নিয়ে আলোচনা হবে।