শ্রমিক হয়ে বিদেশে যেতে ভ য় পান সিলেটের নারীরা!
৩০ জুন ২০২৪, ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ
স্টাফ রিপোর্টার:
কয়েক বছর আগে, বিশেষ করে করোনাকালের পর অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় পরিবারের নারী সদস্যদের কর্মী হিসেবে বিদেশে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
সিলেটও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া নারী শ্রমিকদের অভিবাসনের হার কমে গেছে। এর কারণ ‘নির্যাতন’। সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের নারীদের সৌদি আরবসহ নানা দেশে গিয়ে বর্বর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরার খবর প্রায়ই প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে।
বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে নারী কর্মী পাঠানো শুরু হয় ১৯৯১ সাল থেকে। যেসব দেশে নারী কর্মীরা যায় এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, লেবানন, মালয়েশিয়া, জর্ডান, ওমান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রুনাই, সাইপ্রাস, মৌরিতাস, হংকং, ইতালি, জাপান ইত্যাদি।
তবে, বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী নারীদের বড় অংশ গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব যায়।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত ২০ বছরে বাংলাদেশ থেকে এগার লাখ ৬২ হাজার ৭৯১ জন নারী শ্রমিক বিভিন্ন দেশে যান।
সরকারি এ সংস্থাটির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিদেশে নারী কর্মী যাওয়ার পর থেকে ২০১৭ সালে এক বছরে সর্বোচ্চ এক লাখ ২১ হাজার ৯২৫ জন নারী বিদেশে যান। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বছরে এক লাখের বেশি নারী কর্মী পাঠানোর ধারা অব্যাহত ছিল।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের পরে এ সংখ্যা কমলেও ২০২২ সালে আবার লাখের ঘর পেরোয় নারী কর্মী বিদেশ যাওয়ার সংখ্যা। গতবছর আবার কমে লাখের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ গতবছর সর্বোচ্চ সংখ্যক শ্রমিক প্রবাসী হয়েছে। এ সংখ্যা তের লাখের বেশি। কিন্তু নির্যাতনের কারণে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমে হয়েছে ৭৬ হাজার ১০৮ জন। এ বছরের প্রথম চার মাসে ২১ হাজার ৫৫৮ জন নারী শ্রমিক বিদেশে গেছেন।
সরকারি বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সৌদি আরবেই সর্বোচ্চ বেশি নারী কর্মী যায়। এ হার ৬৩ শতাংশ।
নির্যাতনের অভিযোগ উঠায় ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন গৃহকর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিলে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি আরব।
তবে, বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এসব নারীদের অভিজ্ঞতা অনেক সময়ই সুখকর হয় না বলেঅভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে। কেননা গৃহকর্মী হিসেবে যারা যায়, বেশিরভাগ সময়ই নির্যাতনের শিকার হয়ে তাদের অনেককে দেশে ফিরে আসতে হয়।
করোনা পরবর্তী সময়ে নারী কর্মীদের বিদেশ যাওয়ার সংখ্যা কিছুটা কমলেও ২০২২ সালেও সেই সংখ্যা এক লাখের উপরে ছিল।
কিন্তু গত বছর তা কমে এক লাখের নিচে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হয়েছেন ৭৬ হাজার ১০৮ জন নারী কর্মী। যদিও এই বছরের শুরুর চার মাসে নারীদের অভিবাসী হওয়ার হার আরো কমেছে।
গত কয়েক বছরের তথ্যে দেখা গেছে, বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসছেন অসংখ্য নারী। এছাড়া সেখানে কাজ করতে গিয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু ছাড়াও আত্মহত্যা ও খুনের শিকার হয়েছেন অনেক নারী।
সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনার কারণে নারী কর্মীদের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
২০১৮ সালে সৌদি আরবে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে মাত্র পাঁচ মাসেই দেশে ফিরে আসা এক নারীর বাড়ি সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারে। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “ এজেন্সি সৌদি যে মালিকের বাসায় দিছে তারা খারাপ ছিল। কাজ করাতো, খাবার চাইলে দিতো না, কাপড়-চোপড় দিতো না। মালিক গায়ে হাত দিত। পাঁচ মাসে একদিনও এমন হয় নাই তারা নির্যাতন করে নাই। পরে এমন অবস্থা দাঁড়ায় টিকতে না পাইরা ওই বাসা থেকে পালাই”।
“সৌদি পুলিশের কাছে সাহায্য চাই। পরে তারা অ্যাম্বাসির সাথে কথা বলে কোম্পানির মাধ্যমে দেশে পাঠায়” বলেন এই নারী।
শারীরিক নির্যাতনের কারণে গৃহকর্মী হিসেবে নারী শ্রমিক বিদেশ যাওয়ার সংখ্যা কিছুটা কমেছে বলে স্বীকার করেছেন সরকারি কর্মকর্তারা। তবে, প্রশিক্ষিত হয়ে অন্য পেশায় নারীরা যাচ্ছে বলেও জানান তারা।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক শাহ আবদুল তারিক বলেন, “ বিভিন্ন শারীরিক নির্যাতন – নিপীড়নের অভিযোগের কারণে নারীদের অভিজ্ঞতা ভালো না। তাই গৃহকর্মী হিসেবে নারীদের বিদেশ যাওয়া কমেছে। কারণ এ পেশায় নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে যায় না। এর প্রভাব পড়েছে পুরো সংখ্যায়। কিন্তু অন্য পেশায় প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীরা যাচ্ছে”।
তিনি বলছেন, “ আমরা চাই নারীরা বিভিন্ন পেশায় স্কিলড হয়ে যাক। দেশের বিভিন্ন জেলায় ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, “নারীর অভিবাসন শুধু নির্যাতন সমস্যার কারণে কমেনি বরং ভাষাগত সমস্যা, সেখানে মানিয়ে নিতে না পারাসহ অন্যান্য সমস্যাও রয়েছে। সরকার এসব বিষয় সমাধানে যেমন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, তেমনি তাদের সুরক্ষায় সৌদি আরবে তিনটি সেইফ হোমও করা হয়েছে। অভিযোগ পেলে নারীদের আইনি সহায়তাও দেয়া হয়। সব ধরনের সহায়তাই করা হচ্ছে। ”