স্টাফ রিপোর্টার:
বৃহত্তর সিলেটের ১৯টি আসনের মধ্যে বিএনপি ১৪টি আসনে প্রাথমিকভাবে প্রার্থীদের নাম ঘোষণার পরও আবার কয়েকটি আসনে প্রার্থীদের নাম চূড়ান্ত করেছে। কিন্তু বিএনপির মনোনয়ন বঞ্চিতরা তাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণে মাঠে মরিয়া। জনসংযোগ, মিটিং মিছিলের মাধ্যমে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। দল তাদের আবার মূল্যায়ন করবে এই আশায়।কোনো কোনো স্থানে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এদিকে, নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে নানা অপরাধে বহিষ্কৃত বিএনপি নেতাকর্মীদের দলে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
অন্যদিকে, সিলেটের ১৯ আসনে জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থীদের নাম আগেই ঘোষণা হওয়ায় দৃশ্যত এ দলের মধ্যে প্রার্থী নিয়ে কোনো অসন্তোষ বা ক্ষোভ নেই। জামায়াতের প্রার্থীরা এদিক দিয়ে অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে, এনসিপি দলীয় সূত্র জানিয়েছে সিলেটের তিনটি আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত হয়েছে। বাকি আসনগুলোতে প্রার্থী এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এবার সিলেটে নির্বাচনী লড়াই জমবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে।
সিলেট-১ (সিলেট সিটি করপোরেশন ও সদর): সিলেটের ১৯টি আসনের মধ্যে সিলেট-১ আসনটিকে মর্যাদার আসন মনে করা হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ‘মিথ’ রয়েছে এ আসনে যে দলের প্রার্থী জয়লাভ করেন সেই দলই সরকার গঠন করে। এবার সিলেট-১ আসনে মনোনয়ন পেতে সাবেক মেয়র ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী ও আরেক উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির জোর প্রচেষ্টা চালায়।
পরে আরিফুল হক সিলেট-৪ আসনের প্রার্থী মনোনীত হয়েছেন দাবি করে প্রচারণা শুরু করলে খন্দকার মুক্তাদিরের প্রার্থিতার বাধা দূর হয়। খন্দকার আব্দুল মুক্তাদিরের পিতা খন্দকার আবদুল মালিক বহুবার সিলেট-১ আসনের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। সেই সুবাদে তাদের একটি সমর্থক বলয় রয়েছে এই আসনে। এ কারণে খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির অনেকটা ভার মুক্ত।
অন্যদিকে, এই আসনে বিএনপির অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের মাওলানা হাবিবুর রহমান মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। ঘরে ঘরে লিফলেট বিলি করছেন। তাকে নিয়ে দলে কোনো কোন্দল নেই, নেই কোনো অসন্তোষ।
হাবিবুর রহমনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ইসলামী ছাত্র শিবির থেকে পথ চলা। ১৯৮২ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন। তিনি সিলেট জেলার জেলা আমির থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানেও তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একীভূত সিলেট জেলা আমীর ও কেন্দ্রীয় মজলিসে সূরার সদস্য। এর আগে মাওলানা হাবিবুর রহমান সিলেট-৬ আসন থেকে নির্বাচন করেছিলেন। সিলেট-১ আসনে প্রথম বারের মতো প্রার্থী হয়ে তিনি নির্বাচনী মাঠ জমাতে নিরলসভাবে কাজ করছেন। দলের নেতাকর্মীরা আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন।
এই আসনে অন্য দলের প্রার্থীরা হলেন জমিয়তের আবদুল মালেক চৌধুরী, খেলাফত মজলিশের তাজুল ইসলাম ইসলাম হাসান, ইসলামী ঐক্যজোটের মুফতী ফজলুল হক জালালাবাদী এবং এনসিপির এহতেশামুল হক।
সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর): এই আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন গুম হওয়া নেতা এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর লুনা। তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ারও উপদেষ্টা। লুনার কর্মিসমর্থকরা দিনরাত পরিশ্রম করছেন এলাকায়। তারা সাবেক এমপি বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর গুম প্রসঙ্গ ভোটারদের কাছে তুলে ধরে তাদের মন জয়ের চেষ্টা করছেন। তাছাড়া বিগত সময়ে ইলিয়াস আলীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও তুলে ধরে হচ্ছে।
এই আসনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা হুমায়ূন কবিরও শুরু থেকেই মাঠে নামেন। বেশ আগে এই দুই নেতার কর্মীদের মধ্যে হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটে। অবশেষে হুমায়ূন কবীরকে দলের যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে মনোনীত করায় লুনা আপাতত ঝামেলা মুক্ত।
এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর অধ্যক্ষ আবদুল হান্নান। আবদুল হান্নানের পরিচিতিও ব্যাপক। এলাকায় জনসেবক ও শিক্ষিত মার্জিত রুচিশীল মানুষ হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। তার সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মী ও ছাত্ররা মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। আসনটিতে অন্য দলের প্রার্থীদের মধ্যে খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মদ মুনতাসির আলী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের লুতফুর রহমান মাঠে রয়েছেন।
সিলেট-৩ (ফেঞ্চুগঞ্জ-বালাগঞ্জের একাংশ): এ আসনে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালিক দলীয় মনোনয়ন পেয়ে মাঠ সরগরম করে তুলেছেন। এলাকায় নেতাকর্মীদের নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনি। এই আসনে জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ূম চৌধুরী ও ব্যারিস্টার আবদুস সালামও দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। তাদের কর্মী, সমর্থক ও হিতাকাঙ্ক্ষীরা জোর গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। দুই জনই দলের মূল্যায়ন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। এই দুই জনই বিএনপির দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ও জনপ্রিয় নেতা। তাদের নিজস্ব সমর্থকগোষ্ঠীও রয়েছে।
প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে ঐ এলাকায় দলটির মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধ তীব্র হলে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই আসনটিতে বিজয় কঠিন হবে। এই আসনে বিএনপি প্রার্থীর বিপক্ষে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা লোকমান আহমদ। সিলেটের যেসব আসনে জামায়াতের শক্ত অবস্থান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম এটি। লোকমান দীর্ঘদিন থেকে এলাকায় কাজ করছেন। এছাড়া, এই আসনের অপর প্রার্থীরা হলেন খেলাফত মজলিসের মৌলানা দেলওয়ার হোসেন ও এনসিপির ব্যারিস্টার নূরুল হুদা জুনেদ।
সিলেট-৪ (জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট): এ আসনে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা না দিলেও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী নিজেকে দলীয় প্রার্থী দাবি করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তার দাবি বেগম জিয়ার নির্দেশনায় তিনি এই আসনের প্রার্থী হয়েছেন। এই আসনে জেলা বিএনপির উপদেষ্টা আবদুল হাকিম চৌধুরীও প্রতিদিন মাঠে প্রচার-প্রচারণা ও শোডাউন করে যাচ্ছেন।
আসনটিতে ‘বহিরাগত’ ও ‘স্থানীয়’ প্রার্থী নিয়ে টানাপোড়েন চলছে, উত্তেজনা বাড়ছে। হাকিম চৌধুরীর প্রার্থিতার পক্ষে বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল হচ্ছে। অন্যদিকে, এ আসনে বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সামসুজ্জামান জামান, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকী, মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক বদরুজ্জামান সেলিম ও প্রয়াত এমপি দিলদার হোসেন সেলিমের স্ত্রী অ্যাডভোকেট জেবুন্নাহার সেলিমও দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব না মেটানো হলে বিএনপির জন্য আসনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে অনেকেই মনে করছেন।
অন্যদিকে, এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী জয়নাল আবেদীন শক্ত অবস্থানে আছেন। দুই বারের উপজেলা চেয়ারম্যান ও জাফলংয়ে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত তিনি। শ্রমিকদের মধ্যে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়। এছাড়া খেলাফত মজলিশের মুফতী আলী আহসান উসামা ও এনসিপির রাসেল আহমদও এই আসনে ভোটযুদ্ধে লড়বেন।
সিলেট-৫ (কানাইঘাট-জকিগঞ্জ): এই আসনটিতে প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। জোট হলে আসনটি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মাওলানা উবায়দুল্লা ফারুককে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে সবাই ধারণা করছেন। আসনটিতে জমিয়তের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা উবায়দুলাহ ফারুক প্রচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৮ সালেও তিনি বিএনপি জোট থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে এখানে বিএনপি নেতা চাকসু মামুন দলীয় মনোনয়ন পেতে দীর্ঘদিন থেকে এলাকাবাসীর সঙ্গে কাজ করছেন। বিএনপির এই নেতা মনে করেন তাকে মানোনয়ন দিলে জয় হবে ধানের শীষের।
এই আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা আনোয়ার হোসেন খান। এলাকায় তার সুনাম আছে। তিনি নির্বাচিত হলে এলাকার মানুষের কাছে উন্নয়ন দৃশ্যমান হবে বলে দাবি তার। এই আসনে ফুলতলী হুজুরের নাতিদের মধ্যেও কেউ প্রার্থী হতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। তবে জমিয়ত ও বিএনপি জোট হলে এখানে ভোটের চিত্র পালটে যাবে বলে মনে করেন এলাকাবাসী।
সিলেট-৬ (গোলাপগঞ্জ-বিয়ানীবাজার): আসনটিতে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তরুণ এই নেতা বিশাল বিশাল শোডাউনের পাশাপাশি দিনরাত প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে মনোনয়ন রিভিউ হবে বলে আশা করছেন ২০১৮ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হওয়া বিএনপি নেতা ফয়সল আহমদ চৌধুরীর অনুসারীরা।
আসনটিতে প্রচার-প্রচারণা ও জনসংযোগে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বিএনপি নেতা আবুল কাশেম শামীমও। এলাকায় তিনিও জনপ্রিয়। তার সমর্থকরা মনে করেন আসনটির জন্য প্রার্থী পুনর্বিবেচনা করা হবে।
অন্যদিকে, এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ঢাকা উত্তর জামায়াতের আমির মো. সেলিম উদ্দিন। সেলিম উদ্দিনের জনপ্রিয়তা রয়েছে। নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীরা তাকে জয়ী করতে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন এলাকায়। এলাকায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে তিনি একটি বার সুযোগ চান।