সিলেটে বাসা ভাড়ায় দীর্ঘশ্বাস
২২ ডিসে ২০২৪, ১২:০৯ অপরাহ্ণ
স্টাফ রিপোর্টার:
সিলেট শহরে বাসা ভাড়ার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বাড়িওয়ালাদের কঠোর শর্তের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, ঔষধ বিভিন্ন দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ছে। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাসা ভাড়া। এমন অবস্থায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্য শহরে টিকে থাকা ক্রমেই দুরূহ হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন থাকলেও এটির প্রয়োগ না থাকায় খেয়ালখুশি মতো ভাড়া আদায় করছেন বাড়িওয়ালারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট মহানগরীর পাড়া-মহল্লা সবজায়গায় বাসা ভাড়ার বিজ্ঞপ্তি। তবে এসব বিজ্ঞপ্তির আড়ালে লেখা একাধিক শর্ত। তবুও সামর্থ্য অনুযায়ী নিতে হয় বাসা ভাড়া। গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে ২-৩ বেডরুমের বাসার ভাড়া আগের তুলনায় ৩০-৫০ শতাংশ বেড়েছে। এক বছর আগে যেখানে ১০-১৫ হাজার টাকায় বাসা ভাড়া পাওয়া যেত, এখন সেখানে একই ধরনের বাসার ভাড়া ১৫-২৫ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে, নগরীর লামাবাজার, কাজিরবাজার, হাওয়াপাড়া, এবং আম্বরখানা, শাহী ঈদগাহ, বড়বাজার, খাসদবীর, সুবিদবাজার, জালালাবাদ লাভলী রোড এলাকায় বাসা বৃদ্ধির হার সবেচেয়ে বেশি।
এছাড়া কিছু বাড়িওয়ালা নির্দিষ্ট শর্তে ভাড়াটিয়া নির্বাচন করছেন। সরকারি চাকরিজীবী কিংবা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, সাধারণ চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া পেতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তাছাড়া বড় বা যৌথ পরিবারকে বাসা খুঁজে পেতে আরো বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
খাসদবীর এলাকার বাসিন্দা মামুন মিয়া জানান, আমি একটি ছোট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। ১৫ হাজার টাকার মধ্যে বাসা খুঁজছিলাম, কিন্তু কোনোভাবেই পাচ্ছি না। কিছু বাড়িওয়ালা সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছেন, সরকারি চাকরি না থাকলে বাসা ভাড়া দেবেন না।
এদিকে, সিলেট শহরে কলকারখানার অভাব এবং চাকরির সীমিত সুযোগের কারণে মানুষের আয়ের উৎস বৃদ্ধি পায়নি। এর ফলে অনেকেই উচ্চ ভাড়ার চাপ সহ্য করতে না পেরে শহর ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।
নগরীর সুবিদবাজার এলাকার শাকিল আহমেদ বলেন, ভাড়ার এই চাপে আমরা শহরে থাকা আর চালিয়ে যেতে পারছি না। নিরুপায় হয়ে পরিবার নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি।
শাহী ঈদগাহ এলাকার কাজল শেখ নামক এক সিএনজি অটোরিকশা চালকের মতে নিত্যপণ্যসহ সকল জিনিসের দাম বৃদ্ধির চাপ বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন।অথচ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সবার অবস্থা এমনিতেই নাজেহাল। তার উপর এই বাড়তি বাসা ভাড়ার চাপ সামলানো অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
বাড়িওয়ালাদের দাবি, ব্যাচেলরদের ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা নানা সমস্যার মুখোমুখি হন। যেমন রাত-বিরাতে আসা-যাওয়া, শব্দ করে বিরক্ত করা।
বালুচর এলাকার এক বাড়িওয়ালা জানান, ব্যাচেলরদের কারণে বাড়িতে অনেক সময় ঝামেলা হয়। তাই আমরা এখন পরিবারের জন্য বাসা ভাড়া দিতে বেশি আগ্রহী।
তবে যৌথ পরিবারকে কেন ভাড়া দেয়া হয় না প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার বাসা ছোট। বারবার বাসা ভাড়া বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমার বাসায় ৩ বেডরুমের একটি ফ্ল্যাট আছে। আগে ১৫ হাজার টাকায় ভাড়া দিতাম, কিন্তু সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন ২২ হাজার টাকায় ভাড়া দিতে বাধ্য হয়েছি। অনেকেই অভিযোগ করেন, কিন্তু বাসা সংরক্ষণসহ অন্যান্য খরচ প্রতিনিয়ত বাড়ছে।তাছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তো আছেই।
বাদামবাগিচা এলাকার একটি ভবনের মালিক আব্দুল লতিফ অভিযোগ করেন, ভাড়াটিয়ারাও অনেক সমস্যা তৈরি করেন। অনেকে মাসের পর মাস ভাড়া দিতে চান না। আবার বাড়ি ছাড়ার সময় দেখা যায়, দেয়াল ও ফিটিংস-এর ক্ষতি করে গিয়েছেন। এসব মেরামত করতেও অনেক টাকা খরচ হয়।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ১৯৯১ সালের আইনের সংশোধন করে বর্তমান সময়োপযোগী করতে হবে। আইনটি বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে সরকার বাসা ভাড়া নির্ধারণ করে দিতে পারে। তাছাড়া ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
তিনি বলেন, কমপক্ষে ২ বছর ভাড়া পরিবর্তন করা উচিত নয়। ২ বছর পর ভাড়া বাড়ানো যেতে পারে তবে তা সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ।এর বেশি বাড়ানো ভাড়াটিয়াদের প্রতি জুলুম করা ছাড়া আর কিছু নয়।
সাধারণ মানুষজন বাসা ভাড়ার সংকট মোকাবেলায় সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তাদের দাবি সিলেট শহরের বাসা ভাড়ার নীতিমালা পর্যালোচনা এবং মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
যা আছে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে
বাংলাদেশে প্রচলিত বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন -১৯৯১ অনুযায়ী ধারা ১০,২৩,২৪, ২৫,২৬ বাড়ি ভাড়ার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এই আইন অনেক ভাড়াটিয়ারা জানেন না এবং অধিকাংশ বাসার মালিকও জানেন না এবং মানেন না। যেমন: মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ, এক মাসের অধিক অগ্রীম ভাড়া নেওয়া যাবে না, দুই বছরের আগে বাসা বাড়া বাড়ানো যাবে না, দুই বছর পর বাড়াটিয়াদের সম্মতির ভিত্তিতে বাসা বাড়ানো যেতে পারে, ভাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়াদের আসবাবপত্র ক্রয় বা আটক করতে পারবেন না।
বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার ১৮৮২ সনের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৯৭২ সালে চুক্তি আইন অনুযায়ী ভাড়াটিয়ার নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করলে ভাড়াটিয়াকে যখন তখন উচ্ছেদ করা যাবে না। ভাড়া দেয়ার পূর্বে ভাড়াটিয়াদের স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে বসবাসের উপযোগী করে দেয়া, মেরামত, পানি সরবরাহ করা সহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধার কথা থাকলেও বেশিরভাগ বাসার মালিক তা মানেন না এবং দায়িত্ব পালন করেন না।
তাছাড়া নিয়ম অনুযায়ী বছরের প্রতি চারমাস পরপর পানির টেংক, আন্ডারগ্রাউন্ডের পানির রিজার্ভার জীবাণুমুক্ত করে যে পানি পাবেন তা জীবাণুমুক্ত থাকবে। সিলেট নগরীর বেশিরভাগ বাসার মালিক বছরের পর বছর চলে যায় পানির ট্যাংক পরিষ্কার করেন না। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী প্রতি চার মাস অন্তর অন্তর পানির ট্যাংক পরিষ্কার করার কথা। আইন অনুযায়ী বাসা-বাড়ির মালিকের দায়িত্ব সংস্কার কাজ, মটর মেরামত, ইলেকট্রিসিটি লাইন মেরামত, পানির ট্যাবসহ সব কিছু মেরামত করে দেয়া। কিন্তু দেখা যায় এর কিছুই করেন না।