২৯ দিনের আশ্রয়স্থলের স্মৃতি ৫২ বছরেও ভূলতে পারেননি বিয়ানীবাজারের বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিন তাপাদার
১১ ডিসে ২০২৪, ০১:১৫ অপরাহ্ণ
নিজস্ব প্রতিবেদক:
১৯৭১ সালের ঘটনা। হাকালুকি হাওরের অথই পানিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারের সঙ্গে যুদ্ধে দলছুট হয়ে পড়েন এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। সাঁতরে কোনোমতে ক্লান্ত দেহে পাড়ে ভিড়লেন একটা সময়। একটি হিন্দু বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয় পেলেন। জাতপাত দূরে সরিয়ে পরিবারের সদস্যরা ওই মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা করেন। যুদ্ধদিনের সেই দুঃসময়ে ২৯ দিন ওই বাড়িতে ছিলেন ওই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫২ বছর কেটে গেছে। কিন্তু আশ্রয় দেওয়া বাড়ির কথা ভোলেননি ওই বীর মুক্তিযোদ্ধা। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওরপারের তালিমপুর ইউনিয়নের দ্বিতীয়ারদেহী গ্রামের সেই বাড়িতে তিনি ঘুরতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। সারা দিন বাড়িটিতেই ছিলেন। সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করেন। তাঁর উপস্থিতি বাড়িটিতে আত্মীয়স্বজনের পুনর্মিলনে আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি করে।
আশ্রয় নেওয়া ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম মো. আবদুল মতিন তপাদার। বাড়ি বিয়ানীবাজার উপজেলার চারখাই ইউনিয়নের পইল গ্রামে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। গত ১৬ জানুয়ারি দেশে আসেন। অন্য ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও জীবনের চরম দুর্যোগপূর্ণ সময়ে পরিবারের সদস্যের মতো ওই বাড়িতে ২৯ দিন থেকেছেন, সময়-সুযোগ করে সেই বাড়িটিতে ঘুরতে যান।
আবদুল মতিন তপাদার জানান, যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ২০-২১ বছর। মেট্রিক পাস করে তখনো কলেজে ভর্তি হননি। পাকিস্তানিদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে সারা দেশ উত্তাল। একপর্যায়ে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ভাদ্র মাস। তিনিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ৯০ জনের একটি দল ভারতের কুকিরতল থেকে মৌলভীবাজারের লংলা টিলা এলাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। রাতের মধ্যে বড়লেখা অতিক্রম করে হাকালুকি হাওরে পৌঁছার কথা। কিন্তু পাহাড়ের ভেতরে তাঁরা পথ হারিয়ে ফেলেন।
দলের একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এরপর ৩০ জনের একটি দল পাহাড়ে রাত–দিন কাটিয়ে বড়লেখার কাঁঠালতলি-দক্ষিণভাগের মধ্যবর্তী একটি স্থান দিয়ে হাকালুকি হাওরের দিকে অগ্রসর হয়। পথে ছয়-সাতজনের একটি রাজাকারের দলের বাধার মুখে পড়েন। এরপর ধানখেত, হাঁটুপানি, গলাপানি সাঁতরে আজিমগঞ্জে দলের এক মুক্তিযোদ্ধার আত্মীয়ের বাড়িতে ওঠেন।
ওই বাড়িতে থাকতে খবর পান, রাজাকার আসছে। পরে দশঘড়ির উদ্দেশে হাঁটা শুরু করেন। লক্ষ্য হাকালুকি হাওর। পেছন থেকে রাজাকাররা গুলি করছে। একটি ঘাটে দুটি নৌকা ছিল। তারা নৌকা দুটিতে করে দশঘড়ির একটি বাড়িতে ওঠেন। সেই বাড়িতে দু-তিন ঘণ্টা অবস্থান করে সকাল ১০-১১টার দিকে নৌকায় ভেসে হাওরে চলে যান।
ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, দিনটি ছিল শুক্রবার। বশির নামে দলের একজন হাওরপারের কোনো এক গ্রামে তাঁর আত্মীয়ের বাড়িতে ভাত আনতে যান। রাত ৯-১০টার দিকে হাওরপার থেকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান ভেসে আসে। এতে দলের সদস্যরা কিছুটা ভয় পেয়ে যান। বশিরকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে তাঁদের কাছে যুদ্ধ করার মতো পর্যাপ্ত গোলাবারুদ ছিল না। এরপর খাবারের ব্যবস্থা হবে ভেবে হাওরপারে মন্নান মিয়া নামের স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে যান। কিন্তু মন্নান মিয়া বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর ভাইকে পাওয়া গেল। কিন্তু রাজাকাররা জানলে বাড়ি পুড়িয়ে দেবে ভেবে তিনি রাখতে চাইলেন না। পরদিন শনিবার বিকেলে মন্নান মিয়ার ভাই নৌকা নিয়ে হাওরে তাঁদের জন্য ডাল-ভাত নিয়ে যান। সঙ্গে দুই টিন চিড়া, দুই টিন বাদাম। মুক্তিযোদ্ধারা চারটি নৌকায় ভাগ হয়ে হাওরের মধ্যেই নিরাপদ স্থানে সরে যান।
পরদিন রোববার সকাল ৯-১০টার দিকে অনেকগুলো নৌকা নিয়ে হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা তাঁদের দিকে ছুটে আসে। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে গুলি করে। তাঁরাও পাল্টা গুলি করেন। এ সময় বিয়ানীবাজারের দুজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনী মর্টার শেল নিক্ষেপ করলে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকাগুলো আলাদা হয়ে যায়। তিনি দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হাওরপারে একটি ঘর দেখতে পান।
পানি ঠেলে, সাঁতরে ভোররাতে গ্রামের কাছে গেলে দুজনের দেখা পান। তখন তাঁর উঠে দাঁড়ানোর উপায় ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর লোক শুনে তাঁরা তাঁকে খাওয়ালেন। নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে নৌকায় করে দ্বিতীয়ারদেহী গ্রামের শশধর দাসের বাড়িতে নিয়ে আসেন। ওই বাড়িতে টানা ২৯ দিন ছিলেন তিনি। বাড়ির লোকজন পরিবারের সদস্যের মতোই তাঁকে দেখাশোনা করেছেন, যত্নআত্তি করেছেন। এরপর জুড়ীতে এক আত্মীয়ের কাছে চলে যান। সেখানে থাকতে এলাকা হানাদারমুক্ত হয়। পরে বড়লেখা-চান্দগ্রাম হয়ে বিয়ানীবাজারের চারাবইতে যান। সেখান থেকে সিলেটের জালালপুরে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হন।
তিনি বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে একটি ব্যাংকে চাকরি নেন। ২০০৮ সালে স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। কয়েক দিন আগে শশধর দাসের ছেলে বিবেকানন্দ দাসের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হয়। এবার দেশে ফিরে পথের খোঁজ নিয়ে বাড়িটিতে ছুটে আসেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মতিন তপাদার বলেন, ‘ওই বাড়িতে আশ্রয়ের পর প্রায় দুই সপ্তাহ অসুখে ভুগেছি। মুসলমান জেনেও শশধরের বৃদ্ধ মা আমার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেন। সব সময় খেয়াল রেখেছেন। রোজার মাস ছিল। রোজা রাখতে চাইলে সব ব্যবস্থা করার কথাও বলেন। জায়গাটা দেখার জন্য মন টানে। কিন্তু সুযোগ পাই না। এবার আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে। যদিও যাঁরা জায়গা দিয়েছিলেন, তাঁদের কেউই নেই। তবুও বাড়ির মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি। সঙ্গে আমার স্ত্রীও এসেছেন।’
শশধর দাস এখন আর বেঁচে নেই। তাঁর ছেলে সাবেক ইউপি সদস্য বিবেকানন্দ দাস বলেন, ‘আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়তাম। আমার মনে আছে। তাঁকে কাকু ডাকতাম। ইদানীং যোগাযোগ হয়েছে। খবর নিতাম। কাকাকে পেয়ে খুব ভালো লাগছে।’
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে হাকালুকি হাওরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে জাতির সূর্যসন্তানদের সম্মুখযুদ্ধের অনেক খবরই বর্তমান প্রজন্মের কাছে অজানা বলে মনে করেন স্থানীয় কবি ও সংগঠক রিপন দাস।
রিপন দাস বলেন, যুদ্ধরত অবস্থায় একজন মুক্তিযোদ্ধার দলছুট হয়ে পড়া এবং পরবর্তী সময়ে হাওরপারের হিন্দুপল্লিতে ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে দীর্ঘদিন থেকে চিকিৎসা নেওয়া—সবকিছুই বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। মুক্তিযুদ্ধে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের যে পরোক্ষ অবদান ছিল, সেটাও মনে করিয়ে দেয়। স্বাধীনতার এত বছর পর দুই পরিবারের মিলন নতুন প্রজন্মের জন্য অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।