Beanibazarer Alo

  সিলেট     মঙ্গলবার, ১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ  | ১লা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সুনামগঞ্জে খুনের নাটকে তছনছ তিন পরিবার!

admin

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৩ | ১২:২৭ অপরাহ্ণ | আপডেট: ২৩ মে ২০২৩ | ১২:২৭ অপরাহ্ণ

ফলো করুন-
সুনামগঞ্জে খুনের নাটকে তছনছ তিন পরিবার!

Manual1 Ad Code

স্টাফ রিপোর্টার:
ঘটনার শুরু ২০১৭ সালে। বিলকিস বেগমকে ‘খুন’ করে লাশ গুম করা হয়েছে– এমন অভিযোগে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নামে মামলা ঠুকে দেন মা জমরিদ বেগম। মামলার পর গ্রেপ্তারের ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালান তিন পরিবারের সদস্যরা। এক পর্যায়ে বিলকিসের শাশুড়ি নাজমা বেগম ও দুই মামা ধরা পড়েন পুলিশের জালে; ঠাঁই হয় কারাগারে। গ্রামবাসীর চোখে তাঁরা ‘খুনি’ পরিবার– তাই বিলকিসের স্বামী সাদ্দাম হোসেন, তাঁর ভাই সাগর ও নানি এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এক জনপদ থেকে অন্য জনপদে। প্রায় ছয় বছর পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তদন্তে বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। ঘটনার আগাগোড়াই ছিল নাটক! আদতে বিলকিস খুনই হননি। নিজেকে লুকিয়ে রেখে খুনের নাটক সাজিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে ফাঁসিয়ে দেন তিনি। সাজানো খুনের মামলায় তিন পরিবার তছনছ হওয়ার পর গত শনিবার ‘মৃত’ বিলকিসকে জীবিত পাওয়া গেছে। এ নিয়ে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের কোনারছড়া এবং দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পাথারিয়া গ্রামে।

পালিয়ে বেড়ানো সাদ্দামের পরিবার বিলকিস ও তাঁর মা জমরিদ বেগমসহ এই মিথ্যা মামলার কুশীলবদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে। তাঁরা বলছেন, ছয় বছর ধরে এলাকার মানুষের কাছে ও আইনের চোখে তাঁরা খুনি। মামলার খরচ চালাতে গিয়ে নিঃস্ব তারা। এত বছর ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে তাদের। এর ক্ষতিপূরণও দাবি করেন তিন পরিবারের সদস্যরা।’সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান সমকালকে বলেন, বিলকিস স্বেচ্ছায় স্বামীর ঘর ছেড়ে খুনের নাটক সাজিয়েছিলেন। প্রায় ছয় বছর আত্মগোপনে ছিলেন। তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এলে তাঁকে খুঁজে বের করা হয়। তিনি বলেন, হত্যা মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে, পাশাপাশি মিথ্যা মামলা করার অভিযোগে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Manual5 Ad Code

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, সাদ্দাম হোসেনের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের কোনারছড়ায়। তাঁর বাবা দুলাল মিয়া মোটরসাইকেলে ভাড়ায় যাত্রী টানেন। সাদ্দাম নদীতে বালু তোলার কাজ করতেন। ২০১৭ সালের ১১ মে পাশের দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পাথারিয়া গ্রামের বিলকিস বেগমের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর বিলকিস জানতে পারেন, তিনি সাদ্দামের দ্বিতীয় স্ত্রী। প্রথম স্ত্রী তালাক হয়ে গেছে। প্রথম বিয়ে গোপন করায় সাদ্দামের সঙ্গে বিলকিসের মনোমালিন্য দেখা দেয়। বিয়ের প্রায় দুই মাসের মাথায় বিলকিস ১ জুলাই রাতে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে ঘর ছেড়ে সিলেটে নানাবাড়িতে ওঠেন। সেখানে দু’দিন ঘরেই থাকেন। পরে চলে যান কুষ্টিয়ায়। সেখানে আলামিন নামের এক যুবকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরে ওই যুবকের সঙ্গে রাজশাহীতে যান। ২০১৭ সালের শেষের দিকে আলামিন ও বিলকিসের বিয়ে হয়। পরে চলে যান কুমিল্লায়। সেখানে কিছুদিন থাকার পর আবার ফেরেন রাজশাহীতে। তিন বছর আগে আলামিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁদের ঘরে রয়েছে দুই সন্তান। স্বামী মারা যাওয়ার পর রাজশাহীতেই থাকতেন বিলকিস। সেখানে দর্জির কাজ করতেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় দুই ঈদে তিনি বোরকা পরে সুনামগঞ্জ এসে মায়ের সঙ্গে দেখাও করেন।

Manual3 Ad Code

এদিকে, বিলকিসের মা জমরিদ বেগম মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে– এমন মিথ্যা তথ্যে ২০১৭ সালে তাহিরপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরে আত্মগোপনে থাকা মেয়েকে হত্যার পর গুমের ঘটনা সাজিয়ে সুনামগঞ্জ আদালতে হত্যা মামলার পিটিশন দেন তিনি। আদালতের নির্দেশে ওই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর তাহিরপুর থানা বিলকিসের স্বামী সাদ্দাম হোসেনসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে। অপর পাঁচ অভিযুক্ত হলেন সাদ্দামের মা নাজমা বেগম, ছোট ভাই সাগর, নানি এলাকাবানু, মামা জহির মিয়া ও জালাল মিয়া। গ্রেপ্তারের ভয়ে ছয়জনই ঘরবাড়ি ছেড়ে পালান। জহির ও জালাল তাঁদের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে যান সঙ্গে করে।

মামলাটির প্রথম তদন্ত করে তাহিরপুর পুলিশ। পরে সিআইডির সুনামগঞ্জ জেলা কার্যালয়ে স্থানান্তর হয়। চার বছর পলাতক থাকার পর সাদ্দামের দুই মামা জালাল ও জহির গ্রেপ্তার হন। প্রায় চার মাস কারাভোগের পর জামিনে বের হন তাঁরা। এর আগে সাদ্দামের মা নাজমা ২০-২৫ দিন কারাভোগের পর জামিন পান। সিআইডিতে মামলার পাঁচ তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে। পাঁচ-ছয় মাস আগে সিআইডির সুনামগঞ্জের উপপরিদর্শক এসআই নুর উদ্দিন তদন্তের দায়িত্ব পান। ছয় নম্বর তদন্ত কর্মকর্তা তিনি। তদন্তের এক পর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন, বিলকিস খুন হননি। শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে ফাঁসাতে আত্মগোপনে আছেন। মামলাটি সাজানো। এরপরই বিলকিসকে খুঁজতে থাকে পুলিশ। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সোর্সের মাধ্যমে কৌশলে বিলকিসকে রাজশাহী থেকে শনিবার সুনামগঞ্জে ডেকে আনা হয়। পরে তাকে সিআইডি হেফাজতে নেওয়া হয়। এর আগে তার মা জমরিদ বেগমকে গ্রামের বাড়ি থেকে সিআইডি হেফাজতে নেওয়া হয়। বিলকিস ও তাঁর মা সুনামগঞ্জ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। মিথ্যা মামলা সাজানোর ঘটনা স্বীকারও করেছেন। স্বামী সাদ্দামকে বিলকিসের পছন্দ ছিল না। এ ছাড়া সাদ্দাম প্রথম বিয়ে গোপন রাখায় ক্ষোভ ছিল তাঁর। এসব কারণে আত্মগোপনে থেকে মিথ্যা মামলা দিয়েছেন বলে স্বীকার করেন।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, মিথ্যা মামলা দিয়ে পরে মধ্যস্থতার মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রত্যাশায় এ মামলা করতে কয়েকজনের উস্কানি থাকার তথ্য পেয়েছেন তাঁরা। সাদ্দামের বাবা দুলাল মিয়া জানান, তাঁর দু্‌ই ছেলে সাদ্দাম ও সাগর এবং শাশুড়ি এলাকাবানু এখনও পালিয়ে আছেন। বিলকিসকে জীবিত উদ্ধারের কথা জানানো হয়েছে তাঁদের। তবে তাঁরা বিশ্বাস করছেন না। গ্রেপ্তারের ভয়ে গতকাল সোমবার পর্যন্ত তাঁরা গ্রামে ফেরেননি।

Manual5 Ad Code

দুলাল মিয়া বলেন, ‘আমরা নির্দোষ, এটা প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। বলেছি, বিলকিস খুন হয়নি। বিলকিস আমাদের ফাঁসিয়েছে। এরপরও বিশ্বাস করেনি কেউ। মামলা চালাতে গিয়ে আমার টাকা-পয়সা সব শেষ। ভিটে-জমিও হাতছাড়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ১০-১২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন নিঃস্ব। কাজ করলে খাবার জোটে। যারা মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের ফাঁসিয়েছে, তাদের বিচার চাই।’

Manual3 Ad Code

দুলাল জানান, মামলার পর চিন্তা ও ভয়ে তাঁর মা আছিয়া বেগম এবং শ্বশুর আবদুল হাসিম মারা গেছেন। তাঁরা ভয়ে ঘুমাতে পারতেন না। সব সময় চিন্তা করতেন– পুলিশ যদি এসে তাদেরও ধরে নিয়ে যায়! দুলাল জানান, মিথ্যা মামলার কারণে তাঁর দুই শ্যালকের পরিবারও লন্ডভন্ড হয়েছে। তাঁর শ্যালক জহির ও জালাল স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পালিয়ে যান।

শেয়ার করুন