অপবাদ ও হিংসা: মানব জীবনের নিন্দনীয় কাজ
২৪ মে ২০২৩, ০৭:১১ অপরাহ্ণ
আতাউর রহমান:
মহান আল্লাহ তাআলা তাঁর কোনো বান্দাকে ধন-দৌলত দিয়েছেন, কাউকে আবার স্বাস্থ্য দান করেছেন, কাউকে সুখ্যাতি দিয়েছেন, সম্মান দিয়েছেন, আবার কাউকে জ্ঞান দিয়ে নেতৃত্ব দান করেছেন। কিন্তু যারা হিংসুটে তাদের মনে খায়েশ জন্মায় যে, এ নিয়ামত কেন তার নিজের অর্জিত হলো না? তাই অন্যের ভালো কিছু অর্জিত হলে সে অন্তরে ব্যথা পায়। সে আফসোস করে, কেন ওই ব্যক্তি আমার চেয়ে বড় হয়ে গেল, উন্নতি লাভ করল! এমন মানসিকতাকে বলে- হিংসা।
অপবাদ অর্থ পরনিন্দা, কুৎসা রটনা, পেছনে সমালোচনা, পরচর্চা কিংবা দোষারোপ করা। কারো অনুপস্থিতিতে তাঁর দোষ অন্যের সামনে তুলে ধরা প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে, মানুষের ত্রুটি খুঁজে বেড়ায় ও প্রচার করে।’
এ ধরনের অপবাদ শাস্তিযোগ্য অপরাধ ও শরিয়ত-গর্হিত ঘৃণিত কাজ। এহেন অপরাধে নষ্ট হয় আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক সংহতি। বর্তমান সময়ে সমাজের হিংসুটে শ্রেণির ব্যক্তিরাই অপবাদ করে বেশি। গল্প, গুজব কিংবা আড্ডায় শুধু অনুমানের ভিত্তিতে অন্যের দোষচর্চা, মিথ্যা অপবাদ ও দুর্নাম দেওয়ার মতো ঘটনা এখন সমাজে হরদম ঘটছে।
এ অপবাদ আবার দুই রকম। যথাঃ
[ ১ ] কোন ব্যক্তি দোষী নয়, এটা জেনেও তাকে দোষী সাব্যস্ত করা অথবা নিজে অন্যায় করে তার দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সে বিষয়ে কুৎসা রটনা করা এক ধরনের অপবাদ। এ অপবাদ আরোপের কারণে একজন মানুষ আরেকজনের মান-মর্যাদা বিনষ্ট করে দেয়। এ কর্মের মাধ্যমে অপবাদকারী ব্যক্তি অপরের ক্ষতি করার সাথে সাথে নিজেরও ক্ষতি করে। সে নিজেকে কবিরা গুনাহে লিপ্ত করে।
[ ২ ] কারো মুখের কথা শোনার পর তার সত্যতা যাচাই-বাছাই না করে কিংবা অজ্ঞতা ও সন্দেহবশত: কাউকে অহেতুক কোন দোষের জন্য দায়ী করে কুৎসা রটনা করা ও উপহাস করা মিথ্যাচারের সামীল। মিথ্যা দোষারোপ মানুষের দুশ্চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। এ বিষয়ে সূরা হুজুরাত, আয়াত: ৪৯:৬, ১১-১২-তে মহান আল্লাহ সতর্ক করেছেন। এ ধরনের অপকর্মে অভ্যস্ত দুশ্চরিত্র ও রূঢ় স্বভাবের মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
যারা অপবাদ রটায় তারা সাধারণত হিংসুটে প্রকৃতির হয়। তাদের কর্মকাণ্ডে একটা খারাপ ধারনা সবার মনে জন্ম নেয়। তারা নিজেদেরকে অতি চালাক ভাবলেও মানুষের মনে কোনো স্থান করে নিতে পারে না। সবাই যে তাকে চেনে, কেউ তাকে ভালো দৃষ্টিতে দেখে না- একথা তারা উপলব্ধি করতে জানে না। এ অপবাদ থেকে বাঁচার উত্তম উপায় হলো সন্দেহ বা ধারণার ভিত্তিতে কারো বিরুদ্ধে কোন দোষ চাপিয়ে না দেওয়া।
যারা হিংসুটে তারা অন্যের অর্জনকে মেনে নিতে কষ্ট হয়। হিংসুকরা নিজেদের হিংসা গোপন করতে গিয়ে আকর্ষণীয় যুক্তির আশ্রয়ে সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে ভালো মানুষের বিরুদ্ধে নানাভাবে অপবাদ করে। এদের হৃদয় থাকে সংকুচিত। তাদের জীবনও সুখের হয় না। কারণ, ঘুণ পোকার মতো হিংসুটে ব্যক্তির অন্তর হিংসার আগুনে পুড়ে অশান্তিতে ভোগে। এই হিংসুটের হৃদয় থাকে সর্বদা জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের মত। ফলে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র, ধোঁকা ও মিথ্যাচারের দুর্গন্ধ তার মন থেকে বের হয়। হিংসুকেরা অন্যের ভালো সহ্য করতে পারে না বিধায় কারো উন্নতি বা ক্ষমতায় অভিষিক্ত দেখলে তাদের অন্তরে এক ধরনের জ্বালা অনুভব হয়।
মানব জীবনে অপবাদ আরোপ মারাত্মক নিন্দনীয় ও নিকৃষ্ট কাজ। মিথ্যাচার তাকওয়ার সম্পূর্ণ পরিপন্থী ও জঘন্য পাপাচার। যাদের মধ্যে মিথ্যাচার, পরচর্চা, পরনিন্দা, হিংসা- বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতার মতো ঘৃণ্য বদঅভ্যাস রয়েছে তাদের জন্য ইহকাল ও পরকালের পরিণতি খুব কঠিন ও ভয়াবহ। পবিত্র কোরআনে নিষেধ করা হয়েছে যে: ‘তোমরা মিথ্যা কথন থেকে দূরে থাক।’ [সূরা আল-হজ, আয়াত-৩০]
আজকাল ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ জীবনে ও চাকুরীস্থলে মিথ্যা দোষারোপে অপবাদ আরোপের মাত্রা দিন দিন বদ্ধি পাচ্ছে। নিজের সততা, দক্ষতা ও পারদর্শিতা প্রদর্শনের পরিবর্তে অনেকেই মিথ্যা দোষারোপের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েন। একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অধস্তন বা ঊর্ধ্বতনদের সম্পর্কে মিথ্যা দোষারোপ করা চরম এক বদঅভ্যাসে পরিণত হয়েছে। হাদিস শরিফে মিথ্যা দোষারোপ করার জন্য কঠোর শাস্তির কথা বিধৃত হয়েছে:
‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে এমন দোষে দোষারোপ করবে যা থেকে সে মুক্ত, আল্লাহ তাকে ‘রাদগাতুল খাবাল’ নামক জাহান্নামের গর্তে বাসস্থান করে দেবেন, যতক্ষণ সে অপবাদ থেকে ফিরে না আসে।’ [আবু দাউদ]
মিথ্যা অপবাদের ফলে ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি ঘটে, হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়, সামাজিক বন্ধনে ফাটল দেখা দেয়, পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয়। মানব জীবনের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান দুর্বল করে দেয়।
অপবাদ দিয়ে কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা দোষারোপ মানব চরিত্রের জঘন্যতম কু-অভ্যাস। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘তোমরা মিথ্যা থেকে দূরে থাকবে। কেননা মিথ্যা পাপাচার পর্যন্ত পৌঁছে দেয় আর পাপাচার জাহান্নাম পর্যন্ত পৌঁছে দেয়৷’ [বুখারি ও মুসলিম]
তাই অহেতুক একে অপরকে দোষারোপ করা ব্যাধি থেকে পরিত্রাণ কামনা করা উচিত। মহান আল্লাহ আমাদেরকে এ মিথ্যা অপবাদ থেকে বেঁচে থাকার তওফিক দান করুন! আমীন।