চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন দেশের অন্যতম আলেম শায়খুল হাদীস মুকাদ্দাস আলী, ১২ জানুয়ারী মুন্সিবাজার মাদ্রাসায়ে দোয়া
০৯ জানু ২০২৫, ১২:৫৪ অপরাহ্ণ
জকিগঞ্জ সংবাদদাতা:
বুধবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বার্ধক্যজনিত কারণে সিলেটের জকিগঞ্জ নিজ বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহে রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। তাঁর ইন্তেকালে সিলেটজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
ওইদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় জকিগঞ্জের সোনাসার সংলগ্ন পূর্ব মাঠে জানাযার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে তাঁকে তাঁর কর্মস্থল মুন্সিবাজার ফয়জে আম মাদ্রাসায় শায়েখ আব্দুল গফ্ফার মামরখানি রহ. এর কবরের পাশে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। জানাযার নামে সাবেক এমপি মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরীসহ দেশের প্রখ্যাত আলেম, রাজনীতিবী, জনপ্রতিনিধিসহ হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে।
পারিবারিক সূত্রে জানায়, ব্যক্তিগত জীবনে আল্লামা মুকাদ্দাস আলী রহ. আট সন্তানের জনক। তারমধ্যে তিন মেয়ে শৈশবেই মারা যান। বর্তমানে তিন ছেলে এবং দুই মেয়ে রয়েছেন। তাঁর ছেলেরা আলেম ও হাফেজ এবং শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন।
এদিকে শায়খুল হাদীস আল্লামা মুকাদ্দাস আলীর ইন্তেকালের খবর শুনে তাঁকে শেষবারের মতো একবার দেখতে সকাল থেকে সোনাসার গ্রামের বাড়িতে আসতে থাকেন আলিম উলামাসহ হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষ। তাঁর শেষ বিদায়ে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সৃষ্টি হয় হৃদয়বিদারক এক দৃশ্যের। জানাযায় অংশ নেওয়া লোকজনের কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ।
জানা যায়, শায়খুল হাদীস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী একজন নিভৃতচারী বুজুর্গ ছিলেন। পার্থিব দুনিয়ার তাঁর মধ্যে মোহ-মহব্বত ছিলনা। কিতাব অধ্যয়নেই ছিল সব আনন্দ-আহ্লাদ। প্রশান্তি পেতেন সাদা কাগজের কালো হরফের পবিত্র কোরআন মাজিদের আয়াত, তাফসির ও হাদিসের বাণী বিশ্লেষণে। জীবনের শেষ সময়ে বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লেও কিতাবের মায়া এবং ছায়ায় ছিলেন ফুরফুরে। একদিকে যেমন ইলমে হাদিসের ওপর অগাধ পাণ্ডিত্য, অন্যদিকে নিভৃতচারিতা ও বুজুর্গিতে অতুলনীয় ছিলেন মহান এই বুজুর্গ। তিনি তাঁর কর্মময় জীবনে হাদিসশাস্ত্রের সবচেয়ে বিশুদ্ধ সংকলন সহিহ বুখারী শরীফ একাধারে দীর্ঘ ৬৯ বছর শিক্ষাদানের বিরল দৃষ্টান্ত করেছেন। তাঁর রয়েছেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। এমনকি অনেক শীর্ষ আলেমও তিনির কাছ থেকে হাদিস শাস্ত্রে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন।
তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা জানান, আল্লামা মুকাদ্দাস আলী কিংবদন্তিতুল্য একজন শায়খুল হাদিস হওয়ার পাশাপাশি একজন উঁচুমাপের বুজুর্গও ছিলেন। দেওবন্দে দাওরা শেষ করেই ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়্যিদ আসআদ মাদানি (রহ.)-এর হাতে আত্মশুদ্ধি ও সুলুকের বায়াত হন। এরপর দেশে ফিরে আসায় যোগাযোগ অসুবিধার কারণে ফেদায়ে মিল্লাতের নির্দেশে শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর অন্যতম খলিফা কায়েদে উলামা মাওলানা আবদুল করীম শায়খে কৌড়িয়ার হাতে বায়াত হন এবং ১৩৮৩ হিজরির ২৭ রমজান খেলাফত লাভ করেন। এরপর থেকে হাদিসের পাঠদানের পাশাপাশি আধ্যাত্মচিকিৎসায় মনোযোগ দেন। বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক মেহনতের লক্ষ্যে একটি খানকা চালু করেছিলেন তিনি। বর্তমান সিলেটে খানকাওয়ারি মেহনতের ধারাটি জকিগঞ্জের মুনশিবাজার মাদ্রাসা মসজিদেই কেবল চালু আছে। আর খানকার পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে ছিলেন আল্লামা মুকাদ্দাস আলী। প্রতিবছর রমজানের শেষ দশকে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন জকিগঞ্জ ছুটে যেতেন তার সাহচর্যে থেকে ইতেকাফ করার জন্য।
ইতিমধ্যে আধ্যাত্মিক তরিকায় বেশ কয়েকজন ব্যক্তিত্বকে তিনি খেলাফত প্রদান করেছেন। তাদের অন্যতম হলেন কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়ার শায়খুল হাদিস মাওলানা শফিকুর রহমান জালালাবাদী। তিনি প্রতিবছর রমজানের শেষ দশকে কিশোরগঞ্জ থেকে ছুটে আসতেন শায়খের সাহচর্যে ইতেকাফের জন্য।
সংক্ষিপ্ত আকারে একনজরে শায়খুল হাদিস মুকাদ্দাস আলী: সিলেটের প্রবাদপুরুষ ‘মাটিয়া ফেরেশতা’ নামে খ্যাত শায়খুল হাদিস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী (বারগাত্তার মুহাদ্দিস ছাহেব) ১৯৩৩ সালে ভারত সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলার সোনাসার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিশু বয়সেই তিনি পিতাকে হারান। পরে মায়ের বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র। তিনি প্রথমে ফুফুর কাছে, তারপর নানার কাছে লালিত-পালিত হন। এ সময় তাঁকে অনেক প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়। শৈশব-কৈশোরে মা-বাবার স্নেহ-ছোঁয়াহীন তাঁর বেড়ে ওঠা।
শিক্ষাজীবন: শায়খুল হাদীস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী প্রথমে স্থানীয় সোনাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পাশাপাশি মসজিদের ইমাম মাওলানা মাহমুদ হুসাইনের কাছে কায়দা-আমপারাসহ দ্বীনের বুনিয়াদি শিক্ষা অর্জন করেন। দ্বীনি শিক্ষার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ থাকায় স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ভর্তি হন মাদ্রাসায়ে সাইদিয়া ভরন সুলতানপুরে। সেখানে এক বছর লেখাপড়ার পর ভর্তি হন ভারতের বছলার মারকাজুল উলুম ভাঙ্গা মাদ্রাসায়। ভাঙ্গা মাদ্রাসার প্রায় সব শিক্ষকই ছিলেন শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর সান্নিধ্যধন্য, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। এখানে নাহবেমীর থেকে জালালাইন পর্যন্ত একটানা আট বছর পড়াশোনা করেন। সিলেটে তখন শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি (রহ.)-এর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। ফলে এ সময়ে শায়খ মাদানির বেশ কয়েকজন খলিফার সাহচর্য ও শিষ্যত্ব লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন তিনি। এরপর উচ্চশিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে চলে যান উপমহাদেশের অন্যতম দ্বীনি মারকাজ দারুল উলুম দেওবন্দে। পুন:রায় ভর্তি হন জালালাইন জামাতে। দেওবন্দে তিন বছর ‘ফুনুনাত’ পড়ে ১৩৭৭ হিজরিতে ভর্তি হন দাওরায়ে হাদিসে। বোখারি শরিফের দারস ও সনদ গ্রহণ করেন হজরত ফখরুদ্দিন মুরাদাবাদী (রহ.)-এর কাছ থেকে। এ ছাড়া আল্লামা ইবরাহিম বালিয়াভি (রহ.)-এর কাছে সহিহ মুসলিম ও সুনানে তিরমিজি, মাওলানা ফখরুদ্দিন মুরাদাবাদি (রহ.)-এর কাছে সুনানে আবু দাউদ, মাওলানা জহুরুল হক (রহ.)-এর কাছে শরহে মাআনিল আসার, মাওলানা সাইয়্যিদ হাসান (রহ.)-এর কাছে সুনানে ইবনে মাজাহ, কারি তৈয়্যব (রহ.)-এর কাছে মুআত্তাইন কিতাব পড়েন এবং ইজাজত পান।
শায়খ মুকাদ্দাস আলী দারুল উলুম দেওবন্দে লেখাপড়ায় অভূতপূর্ব কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। দেওবন্দে দাওরা পরীক্ষার পর মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর গিয়ে সেখানে কিছুদিন শায়খুল হাদিস জাকারিয়া (রহ.)-এর সাহচর্য গ্রহণ করেন এবং তাঁর কাছ থেকে বোখারি শরিফের লিখিত ইজাজত লাভ করেন।
কর্মময় জীবন: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তির পর আল্লামা মুকাদ্দাস আলী দেশে ফিরে ১৯৬০ সালে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার মুনশিবাজার মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের শুরু হয়। তখন মুনশিবাজার মাদ্রাসায় হাদিসের জামাত ছিল না, ফলে মিশকাতুল মাসাবিহ, তাফসিরে বয়জাবিসহ গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি পাঠদান করেন। পরের বছরই সেখানে দাওরায়ে হাদিস বিভাগ চালু হয় এবং প্রত্যাশিতভাবে মাওলানা মুকাদ্দাস আলী শায়খুল হাদিসের মসনদ অলংকৃত করেন। সেই থেকে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৬৯ বছর একটানা সহিহ বোখারির দরস দিয়ে আসছিলেন। ফলে তাঁর জীবদ্দশায় হাদিসশাস্ত্রের সবচেয়ে বিশুদ্ধ সংকলন সহিহ বুখারী শরীফ একাধারে দীর্ঘ ৬৯ বছর শিক্ষাদানের বিরল দৃষ্টান্ত রয়েছে।
জকিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি মাওলানা রহমত আলী হেলালী জানান, শায়খুল হাদীস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী রহ. এর মতো বাংলাদেশে আর কোন শীর্ষ আলেম দীর্ঘকাল সহিহ বোখারির দরস দিয়েছেন এমন নজির জানামতে নেই। সম্ভবত পুরো উপমহাদেশে শায়খুল হাদীস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী রহ. এক্ষেত্রে একজন মহান মনীষী।