প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ বন্ধ চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক

Daily Ajker Sylhet

admin

০৫ ফেব্রু ২০২৪, ০৪:৫৯ অপরাহ্ণ


প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ বন্ধ চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক

স্টাফ রিপোর্টার:
ব্যাংক খাতে জাল-জালিয়াতি বা প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ একেবারে বন্ধ বা শূন্যে নামাতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে সংস্থাটি খেলাপি ঋণ কমিয়ে ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে চায়। ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনা, ঋণখেলাপি হলে নতুন ঋণ পাওয়া বন্ধ করা, বেনামি ঋণ ও সীমার অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া বন্ধ করার মাধ্যমে ব্যাংক খাতের আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী করতে চায়। ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব লক্ষ্য অর্জন করতে চায়।

এসব লক্ষ্য অর্জনে রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। একই দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ রোডম্যাপটি অনুমোদন করা হয়েছে। এর আলোকে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিভিন্ন নির্দেশনা জারি করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় ব্যাংকের পর্ষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাসের সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হকসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ কমাতে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে রোডম্যাপ তৈরির ঘোষণা দেয়। একই সঙ্গে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান করা ও ঋণ আদায় বাড়ানোর কথা বলা হয়। এর আলোকে সম্প্রতি ব্যাংকার্স সভায়ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন বার্তা ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের দিয়েছে।

ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন করে ১১ দফা রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। এসব দফায় বিভিন্ন উপদফাও রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আগামী ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। জাল-জালিয়াতি বা প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ একেবারে বন্ধ বা শূন্যে নামিয়ে আনা। সীমার অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া বন্ধ করা, বেনামি ঋণ বিতরণ বন্ধ করা, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণ কমিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
একই সঙ্গে শতভাগ প্রভিশন রেখে খেলাপি ঋণ অবলোপন, অবলোপন করা ঋণ আদায় জোরদার করা, খেলাপিদের আর ছাড় না দেওয়া, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শাস্তির আওতায় আনা, ঋণখেলাপি হলে নতুন ঋণ না দেওয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে রোডম্যাপে। এর পাশাপাশি শেয়ারধারী পরিচালকদের যোগ্যতা নির্ধারণ, যোগ্য স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ, দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা, ঋণ আদায় বাড়িয়ে খেলাপি হওয়া ঠেকানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। অবলোপন করা ঋণ আদায়ে প্রতিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে একটি ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ স্থাপনের কথাও বলা হয়েছে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশের বেশি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রোডম্যাপে আগামী ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়।

এছাড়া খেলাপি ঋণ কমাতে আরও কিছু পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, কোনো ব্যাংকের কোনো ঋণ একাধারে দুই বছর মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে খেলাপি থাকলে সেসব ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রেখে অবলোপন করতে হবে। এতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। শতভাগ প্রভিশন রেখে কোনো ঋণ অবলোপন করলে ব্যাংকের কোনো ঝুঁকি তৈরি হবে না। একই সঙ্গে অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায়ও বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রতিটি ব্যাংকে অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বা প্রধান নির্বাহীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে ‘অবলোপনকৃত ঋণ আদায় ইউনিট’ নামে একটি পৃথক ইউনিট গঠন করতে হবে। প্রতিবছর এ খাতের ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানাতে হবে। এই ঋণ আদায়ের লক্ষ্য অর্জন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পারদর্শিতায় যুক্ত করা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি কঠোরভাবে মনিটর করবে। পাশাপাশি ব্যাংকের কোনো ঋণ যাতে নতুন করে খেলাপি না হয় সেদিকেও নজর রাখা হবে। এ লক্ষ্যে ঋণ আদায় বাড়াতে হবে।

ইচ্ছাকৃত যেসব ঋণখেলাপি রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণ পরিশোধ করছেন না বা কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই ঋণ পরিশোধ করা থেকে বিরত থাকছেন তাদের ইচ্ছাকৃত খেলাপির আওতায় ফেলা হবে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো ঋণখেলাপি নতুন ঋণ নিতে পারবে না। একই সঙ্গে ঋণ নিয়ে গাড়ি-বাড়ি কিনতে পারবে না। ঋণখেলাপিদের সম্পদের ওপরও তদারকি করবে ব্যাংক। সে ক্ষমতা ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হবে। অর্থাৎ কোনো ঋণখেলাপি অন্য ব্যাংকে গিয়ে ব্যবসা করাও আটকে দেওয়া হবে।

ব্যবসা করতে হলে আগে খেলাপিমুক্ত হতে হবে। ঋণের বিপরীতে দেওয়া জামানতেও তদারকি বাড়ানো হবে। ঋণের জামানত বাধ্যতামূলকভাবে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে দিয়ে মূল্যায়ন করাতে হবে। এ লক্ষ্যে আইনি কাঠামো আরও শক্তিশালী করা হবে। একই জামানত যাতে অন্য কোনো ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ঋণ নিতে না পারে সে ব্যবস্থাও থাকবে তদারকির আওতায়। এ খাতে তদারকি আরও বাড়ানোর জন্য বেসরকারি খাতে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় নতুন আইন প্রণয়ন করা হবে। এতে মন্দ ঋণ এবং অবলোপনকৃত সম্পদ সেই কোম্পানির কাছে বিক্রয় করে ব্যাংকগুলো তাদের আর্থিক স্থিতিপত্র পরিষ্কার করতে পারবে এবং প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংকের আয় হিসাবে যুক্ত হবে। রোডম্যাপে আরও বলা হয়, ঋণ পরিশোধের জন্য দেওয়া বাড়তি মেয়াদ আর বৃদ্ধি করা হবে না। এখন থেকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এতে ব্যাংকের তারল্য সংকট কমবে। ব্যাংকের খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হবে। খেলাপি ঋণের মেয়াদ কমানো হবে। একে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হবে। খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানোর জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করতে বিশেষ ভাতা চালুর কথাও বলা হয়েছে রোডম্যাপে।

ব্যাংকিং খাতের সুশাসন নিশ্চিতে ব্যাংকের শেয়ারধারী পরিচালকদের যোগ্যতা ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত নীতিমালা সংশোধন করে আরও স্পষ্টীকরণ কঠোর করা হবে। একই সঙ্গে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এতে ব্যাংকের সামগ্রিক ঋণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হবে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ, তাদের সম্মানী নির্ধারণ এবং দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কিত নীতিমালা আরও স্পষ্ট করা হবে। একই সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে নতুন বিধিমালা প্রণয়ন করা হবে। এতে স্বতন্ত্র পরিচালকরা আমানতকারী ও শেয়ারধারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে। এখন দুই-তিনটি ব্যাংক ছাড়া সব ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালকরা শেয়ারধারী পরিচালকদের অনুগত। ফলে তারা পরিচালনা পর্ষদের স্বার্থই বেশি দেখছেন। আমানতকারীদের স্বার্থ দেখছেন না। এটি ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্যতম বাধা।

ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডি নিয়োগ ও পুনঃনিয়োগে বাছাই প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। দক্ষতার ভিত্তিতে এমডিদের কাজের মূল্যায়ন করা হবে। এখন এমডিদের ক্ষেত্রে নজরদারি তুলনামূলকভাবে কম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনা এখন একজন গ্রাহক যে ঋণ নিতে পারে, তার বেশি ঋণ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। অর্থাৎ সীমার বেশি ঋণ নিতে পারবে না। কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হবে। এতে একীভূত হওয়ার তিন বছর পর্যন্ত কাউকে চাকরিচ্যুত করা যাবে না। এর মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ শক্তিশালী হবে, মূলধন ঘাটতি দূর হবে ও খরচ কমে আসবে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে মৌলিক প্রশিক্ষণ ও ব্যাংকিং প্রফেশনাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বাধ্যতামূলক করা হবে।

Sharing is caring!