মাথা মিলছে না চট্টগ্রামে খু ন হওয়া সিলেটি হাসানের, পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে তল্লাশি
০৩ অক্টো ২০২৩, ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ
স্টাফ রিপোর্টার:
গত ২১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগরের পতেঙ্গা থানা এলাকায় লাগেজ থেকে একটি খণ্ডবিখণ্ড মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশটি ছিলো মো. হাসান নামের ৬০ বছর বয়েসি এক বৃদ্ধের।
পুলিশের বক্তব্য- ওই ব্যক্তির বর্তমান ছিলো ঠিকানা সিলেট সদর উপজেলার সাধুরবাজার সংলগ্ন রেলওয়ে কলোনি এলাকায়। সম্পত্তি লিখে না দেওয়ায় স্ত্রী ও সন্তানরা মিলে তাকে হত্যা করে।
সেদিন মরদেহ মিললেও মাথা ছিলো বিচ্ছিন্ন। ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ হতে চললেও মরদেহের মাথা এখনো পাওয়া যায়নি। রবিবার ও সোমবার (১ ও ২ অক্টোবর) ওই বৃদ্ধের অভিযক্ত পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে খণ্ডিত মাথা উদ্ধারে পতেঙ্গার ১২ নম্বর ঘাট এলাকায় তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) টিম। কিন্তু হাসানের খণ্ডিত মাথা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
জানা যায়, গত ২১ সেপ্টেম্বর পতেঙ্গা থানার ১২ নম্বর ঘাট এলাকায় সড়কের পাশে পড়ে থাকা একটি লাগেজ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল মানুষের শরীরের ৮টি খণ্ড। এর মধ্যে ছিল ২ হাত, ২ পা, কনুই থেকে কাঁধ এবং হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত অংশ। প্রত্যেকটি অংশ টেপ দিয়ে মোড়ানো ছিল। তবে ওই লাগেজে ভুক্তভোগীর মাথা না থাকায় তাৎক্ষণিক পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কাদির বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বা ব্যক্তিদেরকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এদিকে, খণ্ডবিখণ্ড এই মরদেহ পরিচয় শনাক্ত ও রহস্য উন্মোচনে মাঠে নামেন পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা পিবিআই। তারা প্রথমে ফিঙ্গার প্রিন্টের সহায়তায় নিহত ব্যক্তি মো. হাসান (৬০) বলে শনাক্ত করেন। জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী হাসান চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীর উপজেলার কাথারিয়া এলাকার সাহেব মিয়ার ছেলে। তবে তার বর্তমান ঠিকানা সিলেট সদর উপজেলার সাধুরবাজার সংলগ্ন রেলওয়ে কলোনি এলাকায় বলে জানায় পিবিআই।
পিবিআই জানায়, অন্তত ৩০ বছর ধরে ভুক্তভোগী হাসানের সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগ ছিল না। এসময়ে তিনি কোথায় ছিলেন তাও জানতেন না পরিবারের সদস্যরা। গত এক বছর আগে হঠাৎ তিনি স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন হাসান। তাঁর নামে কিছু পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। যেগুলো নিজেদের নামে লিখে দেওয়ার জন্য হাসানের স্ত্রী এবং সন্তানরা তাঁকে চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু তিনি বিষয়টিতে রাজি ছিলেন না। এ নিয়ে বিরোধের জেরে গত ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মহানগরের ইপিজেড থানার আকমল আলী রোডের পকেট গেট এলাকার জমির ভিলা ভবনের একটি বাসায় স্ত্রী-সন্তানরা মিলে হাসানকে হত্যা করে টুকরো টুকরো করে ফেলে। এটি হাসানের ছোট ছেলের বাসা ছিল।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) একেএম মহিউদ্দিন সেলিম বলেন, সিসিটিভি ফুটেজে আকমল আলী রোডের সেই বাসা থেকে হাসানের ছেলেকে বস্তায় ভরে মরদেহ বের করতে দেখা যায়। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় জানা যায়- ১৯ সেপ্টেম্বর হাসান, তার স্ত্রী ও দুই ছেলের অবস্থান বাসাটিতে ছিল। ওইদিনই সম্পত্তি লিখে দেওয়া নিয়ে তর্কাতর্কির জেরে হাসানকে খুন করা হয়।
তিনি আরও বলেন, অভিযুক্তরা মরদেহের খণ্ডিত অংশগুলো কয়েকভাগে ফেলে দেয়, যাতে হত্যাকাণ্ডের কোনো ক্লু পাওয়া না যায়। কিন্তু পিবিআইয়ের তদন্তে অভিযুক্তদের শনাক্ত এবং দুজনকে আটক করা হয়েছে। তাদেরকে নিয়ে হাসানের মরদেহের অবশিষ্ট অংশ উদ্ধারে চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় জড়িত হাসানের আরেক ছেলেসহ অন্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
এদিকে, হাসানের খণ্ডিত মস্তক উদ্ধারে পুত্রবধূ আনারকলিকে নিয়ে দুদিন (রবি ও সোমবার) পতেঙ্গা থানার ১২ নম্বর ঘাট এলাকায় তল্লাশি চালিয়েছে পিবিআই। সোমবার ভোর সাড়ে ৫টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সম্ভাব্য সব স্থানে অভিযান চালিয়েও হাসানের খণ্ডিত মাথা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খান বলেন, ১৫ জনের একটি টিম দ্বিতীয় দিনে অভিযানে অংশ নেয়।
পিবিআই সূত্র জানায়, দুপুর ২টা পর্যন্ত ঘাট এলাকার পাথরের ফাঁকে, বালুর স্তুপের নিচে খণ্ডিত মাথা তল্লাশি করা হয়। সাগরে অতিরিক্ত স্রোতের কারণে তল্লাশি কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হয়। পরে বৃষ্টি শুরু হলে অভিযান স্থগিত করা হয়। বৃষ্টি থামলে আবারো অভিযান শুরু হয়।
হাসানকে খুন করার পর ট্রলিব্যাগ ও শপিংব্যাগে করে লাশের খণ্ডিত অংশ বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়। ওই সময় হাসানের ছোট ছেলে সফিকুর রহমানের সঙ্গে তার স্ত্রী আনারকলিও ছিলেন। তাই রিমান্ডে থাকা আনারকলিকে নিয়েই পিবিআই সম্ভাব্য স্থানে অভিযান পরিচালনা করেছে।
এদিকে, অভিযুক্ত আনারকলি সাংবাদিকদের বলেন- ‘শ্বশুরকে হত্যার পর তার টুকরো করা লাশ গুমের চেষ্টাসহ সব কাজে স্বামীকে সহযোগিতা করে আমি বড় পাপ করেছি। মানুষের সর্বোচ্চ আদালত হচ্ছে তার বিবেক। কিন্তু তখন আমার বিবেক নয়, আবেগ কাজ করেছে। তাই আমি এত বড় পাপে জড়িয়েছি। এখন বুঝছি এটা করা আমার ঠিক হয়নি। আমি বড় অপরাধ করেছি। তবে আমি যদি জানতাম আমার শ্বশুরকে হত্যা করা হবে বা হত্যার পরিকল্পনা করা হচ্ছে-তবে আগেভাগেই তা শ্বশুরকে জানিয়ে দিতাম। তাকে বাঁচানোর জন্য বাসা থেকে বের করে দিতাম। কিন্তু স্বামী ও ভাসুর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার পর কী করব তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। স্বামীর ভালোবাসার টান ও সংসারের কথা মাথায় রেখে তার কাজে সহযোগিতা করেছি। আমি পরিস্থিতির শিকার হয়েছি।’
তিনি আরও বলেন- ‘আমি একবারও নিজেকে নির্দোষ দাবি করছি না। আমি দোষী। আমার সন্তানের কপালে যা আছে তা হবে। আমার মা-বাবা ও ছোট ভাইরা যতদিন আছে ততদিন ইনশাল্লাাহ আমার সন্তানের সমস্যা হবে না। ওরাই আমার সন্তানকে দেখে রাখবে। আমার বিবেক যদি কাজ করত তাহলে একবার হলেও আমার সন্তানের কথা ভাবতাম। এত বড় পাপের মতো ঘটনায় জড়িয়ে যেতাম না।’
তিনি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘প্রথমে শ্বশুর হাসানের লাশ টুকরো টুকরো করা হয়নি। আমি তাকে বস্তার মধ্যে ঢুকানোর সময় দেখেছি। তখন কি তিনি মৃত ছিলেন না জীবিত ওটা জানি না। তারপর আমি আর কিছু দেখিনি। আমার ধারণা লাশ টুকরো টুকরো রাতে করেছে, দিনে নয়।’
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খান সোমবার স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, সম্পত্তি লিখে না দেওয়ার জের ধরে দুই ছেলে মোস্তাফিজ ও সফিকুর রহমান মিলে বাবা হাসান আলীকে বাসায় ডেকে এনে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে। ২০ সেপ্টেম্বর দিনে হত্যা করলেও রাতে তার লাশ টুকরো করা হয়। ২১ সেপ্টেম্বর সকালে হাত-পা কেটে ৮ টুকরো করার পর তা পুত্রবধূ আনারকলি ট্রলিব্যাগে ভরে এবং মাথা শপিংব্যাগে ভরে পতেঙ্গা থানার ১২ নম্বর ঘাটে নিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। দেহ অপর একজনকে দিয়ে বস্তায় ভরে ফেলে দেওয়া হয় একটি খালে।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার পরদিনই হাসানের শরীরের সব অঙ্গ উদ্ধার করা হলেও মাথা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ঘটনার পর একাধিকবার জোয়ার-ভাটা হয়েছে। এ কারণে বালিতে বা অন্য কিছুতে খণ্ডিত মাথা হয়তো চাপা পড়েছে। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি সেটি উদ্ধার করতে। এটি উদ্ধার করা গেলে মামলা প্রমাণ করা আরও সহজ হবে।