আলোচিত সাত খুনের ৯ বছর, রায় কার্যকরের প্রতীক্ষায় স্বজনেরা
২৭ এপ্রি ২০২৩, ১২:০৬ অপরাহ্ণ
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি:
বাবাকে ছাড়াই এক বুক কষ্ট নিয়ে বেড়ে উঠছে ৯ বছরের শিশু রওজা। তার কাছে বাবা মানে শুধু অ্যালব্যামের ছবি আর মায়ের কাছে শোনা হৃদয় বিদারক এক খুনের গল্প।
আলোচিত সাত খুনের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ৯ বছর অতিবাহিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের গর্ভে থাকতে বাবা জাহাঙ্গীর আলমকে হারানো রওজাও আট পেরিয়ে ৯ বছরে পা দিয়েছে। বাবার ছবি বুকে ঝাপটে ধরে রওজার চোখে-মুখেও যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে নারকীয় এই হতাকাণ্ডে জড়িতদের ফাঁসির রায় বাস্তবায়নের দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রতিচ্ছবি। বুধবার (২৬ এপ্রিল) দুপুরে সাত খুনের ঘটনায় নিহত জাহাঙ্গীরের পরিবারের খোঁজ নিলে এমনি দৃশ্যের দেখা মেলে।
চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ৯ বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এখনো রায় কার্যকর হয়নি।
সাত খুনের ঘটনায় নিহত জাহাঙ্গীর আলম কাউন্সিলর মনিরুজ্জামান স্বপনের ব্যক্তিগত গাড়ির চালক ছিলেন। নিহত জাহাঙ্গীর তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। বাবার আদর-ভালোবাসা ছাড়া বড় হচ্ছে ৯ বছরের ছোট্ট শিশু রওজা। নারকীয় ওই ঘটনায় জাহাঙ্গীর ছাড়াও নিহত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ আরও ছয়জন। তাদের নৃশংস কায়দায় হত্যা করে মরদেহের সঙ্গে প্রায় অর্ধ শতাধিক ইট বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।
জাহাঙ্গীরের পরিবারে সদস্য বলতে রয়েছেন তার মা, স্ত্রী ও এক কন্যা সন্তান। তারা সবাই চান এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে আদালতের রায় দ্রুত কার্যকর হোক।
ছোট্ট শিশু রওজা তার বাবার খুনিদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে বলেন, যারা আমাকে এতিম করেছে তাদের যেন ফাঁসির ব্যবস্থা করা হয়। আমি আমার বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতে পারি না। আমি প্রত্যেক খুনির ফাঁসি চাই।
সাত খুনের ঘটনায় নিহত জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শামসুন নাহার ওরফে নুপুরের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি ও আমার সন্তান হলাম হতভাগিনী। বিয়ে হলো স্বামীর সঙ্গে ঠিকমত সংসার করতে পারলাম না। কত রঙিন স্বপ্ন ছিল, সব শেষ হয়ে গেল। আমাদের টানাপোড়নের সংসারে কখনো সুখের কমতি ছিল না। আর আমার মেয়ের কথা আর কি বলব বলেন? ওর ভাগ্যটা আরও বেশি খারপ। সে দুনিয়াতে আসার আগেই তার বাবাকে হারালো। রওজা তখন আমার পেটে, গর্ভকালীন সাড়ে সাতমাস চলছিল। ঠিক সেই সময় তারা আমার স্বামীকে নারকীয়ভাবে হত্যা করে মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়।
‘আমার পোলাডারে যারা খুন করলো বাইচ্চা থাকতে যদি ওগো ফাঁসির রায় কার্যকর হইসে এইডা দেইখা যাইতে পারতাম, তয় মইরাও শান্তি পাইতাম।’ ছেলে হারানোর কষ্ট বুকে চেপে সন্তান হারা মা মেহেরুন বেগম বিচারের আশায় এভাবেই ঢাকা পোস্টকে কথাগুলো বলছিলেন। তিনি আরও বলেন, বয়স হয়েছে অনেক, এবার যাবার অপেক্ষায় আছি। যারা আমার মানিকরে খুন করে আমার বুক খালি করলো তাদের সঠিক বিচার হতে দেখলে কিছুটা শান্তি পেতাম। আমার এই নাতনিটার জন্য বড়ো মায়া হয়। আজকে ওর বাবা বেঁচে থাকলে জীবনটাই অন্যরকম হতো। বাবা ছাড়া মেয়েটা কেমনে বড়ো হচ্ছে তা আমরা ছাড়া আর কেউ জানে না।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ও সন্তান হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তারা। সরকারের কাছে কোন চাওয়া-পাওয়া আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আমার সন্তান হারিয়েছি, এই ক্ষতি পূরণ হবার নয়। এত দিনে যেহেতু কেউ কিছুই করে নাই, কারো কাছে আর চাওয়ারও কিছু নাই আর পাওয়ারও কিছু নাই। তবে স্বজন হারানোর ব্যাথা শেখের বেটি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) বুঝে। সে সরকার বাহাদুর, তার কাছে একটাই দাবি যেন এই রায় দ্রুত কার্যকর হয়।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের সদর উপজেলার লামাপাড়া এলাকা থেকে সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও নারায়ণগঞ্জ জজ আদালতের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়। ঘটনার দিন একে একে হত্যা করা হয় সাতজনকে। এর তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল দুপুরে শীতলক্ষ্যা নদীতে মরদেহ ভেসে ওঠে। পরে প্রশাসনের সহায়তায় বন্দরের শান্তিনগর এলাকার শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। মরদেহগুলোর হাত-পা দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায় ছিল। এছাড়া প্রত্যেক মরদেহের সঙ্গে দুই বস্তা করে ইট বেঁধে দেওয়া ছিল যেন ভেসে উঠতে না পারে।
নিহত সাতজন হলেন, প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু যুবলীগ কর্মী মনিরুজ্জামান স্বপন ও তার গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, লিটন, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু–কিশোর পরিষদের সিদ্ধিরগঞ্জ থানা কমিটির সহ সভাপতি তাজুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম।
মরদেহ উদ্ধারের পর নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার বাদী হয়ে ফতুল্লা মডেল থানায় পৃথক দুটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। আলোচিত এ মামলায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১-এর চাকরিচ্যুত সাবেক অধিনায়ক লেফট্যানেন্ট কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন, লেফট্যানেন্ট কমান্ডার এম এম রানাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়ে রায় প্রদান করেন আদালত। নিম্ন আদালতের রায়ের পর উচ্চ আদালতে ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা বহাল রাখেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে মামলাটি আপিল বিভাগে আসামি পক্ষের আপিল নিষ্পত্তির জন্য শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।